শীর্ষ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলায় প্রশাসনে আতঙ্ক ও অচলাবস্থা

গত কয়েক মাস ধরে বাংলাদেশে রাজনৈতিক পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারি প্রশাসনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা দায়ের হচ্ছে। ছাত্র-জনতার গণ–অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিশেষত হত্যাকাণ্ডের দায়ে বেশ কিছু শীর্ষ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এসব ঘটনায় প্রশাসনের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিতর্কিত কিছু কর্মকর্তা অতিরিক্ত ক্ষমতা প্রয়োগ করেছেন, যাদের বিচার হওয়া উচিত। তবে ঢালাও মামলা দায়েরের কারণে প্রশাসনের কাজে স্থবিরতা তৈরি হচ্ছে এবং অনেক কর্মকর্তা আত্মগোপনে চলে গেছেন।

গত কয়েক সপ্তাহের মধ্যে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পাঁচজন মুখ্য সচিবের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, যার মধ্যে তিনজন গ্রেপ্তার হয়েছেন এবং বাকি দুজন আত্মগোপনে আছেন। জনপ্রশাসনের কর্মকর্তারা বলছেন, এর আগে কখনো উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের নামে এমন হত্যা মামলার ঘটনা ঘটেনি। গ্রেপ্তার হওয়া শীর্ষ কর্মকর্তাদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক মুখ্য সচিব কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী, আবুল কালাম আজাদ এবং নজিবুর রহমান। অন্যদিকে, তোফাজ্জল হোসেন মিয়া এবং আহমেদ কায়কাউসের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, যেখানে একজন দেশের বাইরে এবং অন্যজন আত্মগোপনে রয়েছেন।

জনপ্রশাসনের আরেক গুরুত্বপূর্ণ পদ মন্ত্রিপরিষদ সচিবেরও একই পরিণতি হয়েছে। খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম ও কবির বিন আনোয়ার—এ দুই সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিবের বিরুদ্ধেও মামলা হয়েছে এবং তাঁরা গ্রেপ্তারের ভয়ে আছেন। অন্যদিকে, মাহবুব হোসেন নামে আরেকজন মন্ত্রিপরিষদ সচিবের বিরুদ্ধে যাত্রাবাড়ী থানায় দায়েরকৃত একটি হত্যা মামলা নিয়ে বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছে, যেখানে মামলার বাদী দাবি করেছেন যে ভুলবশত তাঁকে মামলায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

গত আগস্ট থেকে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে বেশ কয়েকজন সচিবকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) এবং বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে। প্রশাসনের মোট চারজন সচিব ইতিমধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছেন, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন সাবেক স্বরাষ্ট্র সচিব মো. জাহাঙ্গীর আলম, আমিনুল ইসলাম খান, শাহ কামাল এবং মেজবাহ উদ্দীন আহমেদ। এ ছাড়া আরও কয়েকজন সচিবের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হয়েছে এবং গ্রেপ্তার আতঙ্কে তারা আছেন।

এই পরিস্থিতি নিয়ে প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তাদের মধ্যে দুটি ভিন্ন মতামত দেখা যাচ্ছে। একদল বলছেন, গত ১৫ বছরে প্রশাসনের অনেক কর্মকর্তাই রাজনীতির সঙ্গে অতিমাত্রায় জড়িয়ে পড়েছেন এবং তারা রাজনৈতিক ব্যক্তিদের মতো আচরণ করেছেন। ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের বিতর্কিত জাতীয় নির্বাচনগুলোতে তাদের সরাসরি অংশগ্রহণের কারণে জনগণের মধ্যে প্রশাসনের ওপর আস্থা হারিয়েছে। তারা যুক্তি দিচ্ছেন, এই ধরণের মামলার মাধ্যমে দায়ী কর্মকর্তাদের বিচারের আওতায় আনা উচিত।

অন্যদিকে, আরেক দল বলছেন, আমলারা শুধু বিগত সরকারের আদেশ পালন করেছেন। তাদের মতে, যারা সীমা লঙ্ঘন করেছেন, তাদের অবশ্যই বিচার হওয়া উচিত, কিন্তু ঢালাওভাবে মামলা দায়ের ও গ্রেপ্তারের ফলে প্রশাসনের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হচ্ছে এবং কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ছে। অনেক কর্মকর্তা, যারা ইতিমধ্যে অবসরে গেছেন, তারাও গ্রেপ্তারের আশঙ্কায় আছেন। এই ধরণের মামলার প্রভাব দীর্ঘমেয়াদে প্রশাসনের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে এবং এর ফলে ভবিষ্যতে অন্য সরকারের অধীনে প্রশাসনের জন্য এটি একটি দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়াবে।

আইন বিশেষজ্ঞরা এই পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তারা বলছেন, হত্যা মামলা দায়েরের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকতে হয়, যা এখন ঢালাওভাবে হচ্ছে। এভাবে মামলা দায়েরের ফলে অপরাধ প্রমাণিত নাও হতে পারে এবং প্রকৃত অপরাধীরা পার পেয়ে যেতে পারে।

গত ১৫ বছরে আমলাদের রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এবং তাদের ক্ষমতাচর্চার ধরন নিয়ে বিভিন্ন সময়ে সমালোচনা হয়েছে। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের ২০২১ সালে বলেছিলেন, রাজনীতির মাঠে খেলছেন আমলারা, আর রাজনীতিবিদেরা সাইডলাইনে বসে খেলাটি দেখছেন। সংসদেও আমলাদের অতিরিক্ত খবরদারি ও ক্ষমতার অপব্যবহার নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। প্রশাসনের মধ্যে রাজনৈতিক প্রভাব এতটাই প্রখর হয়ে উঠেছিল যে, যোগ্য কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দেওয়ার ক্ষেত্রে বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়েছে।

সাবেক সচিব ও বাংলাদেশ লোকপ্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের (বিপিএটিসি) রেক্টর এ কে এম আবদুল আউয়াল মজুমদার বলেন, সরকার পরিবর্তন হতে পারে, কিন্তু আমলাদের নিরপেক্ষ থাকতে হবে। গত ১৫ বছরে দলীয় আমলাতন্ত্র তৈরি হয়েছে, যার ফলস্বরূপ এখন তাদের বিচার হচ্ছে। বর্তমানে যারা দায়িত্বে আছেন, তাদের পেশাদারিত্বের সঙ্গে কাজ করা উচিত এবং অতীত থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা জরুরি।

প্রশাসনের এই পরিস্থিতি বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক বাস্তবতার প্রতিফলন। ঢালাও মামলা দায়েরের মাধ্যমে প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তাদের বিচারের আওতায় আনা হলেও এর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ থাকছে, যা ভবিষ্যতের প্রশাসনের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়াতে পারে।

Tags

- Advertisement -