বাজারে দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন বৃদ্ধি ও কার্যকর পদক্ষেপের অভাব

বাংলাদেশের বাজার পরিস্থিতি এখন এক অস্বাভাবিক অবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে, এবং কোনো পদক্ষেপই তা নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না। বিক্রেতারা ইচ্ছামতো পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন। সাধারণ জনগণ, বিশেষত নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষ, এই মূল্যবৃদ্ধির চাপে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পর মানুষ আশা করেছিল যে দ্রব্যমূল্য কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণে আসবে, কিন্তু বাস্তবে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। প্রতিদিন যেন নতুন করে দাম বৃদ্ধি পেয়ে যাচ্ছে, যা একটি পাগলা ঘোড়ার মতো লাগামহীন হয়ে উঠেছে।

প্রধান সমস্যাটি হলো—পণ্যের বাজারে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। সরকার যে গুরুত্ব দিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারত, তা এখনও অনুপস্থিত। বিশেষ করে ডিম ও ব্রয়লার মুরগির দাম সাধারণ মানুষের জন্য এক বিশাল সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ডিম, যা নিম্ন আয়ের মানুষের প্রোটিনের অন্যতম প্রধান উৎস, তার দাম এতটাই বেড়েছে যে তা এখন অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে। সাম্প্রতিক সময়ের এক হিসাবে দেখা যায়, প্রতি ডজন ডিমের দাম ১৮০ টাকার ওপরে চলে গেছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার সাতটি প্রতিষ্ঠানকে ডিম আমদানির অনুমতি দিয়েছে, কিন্তু এই পদক্ষেপ বাজারে তেমন কোনো ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারছে না। একইভাবে ব্রয়লার মুরগি ও সবজির দামও এখন ক্রমাগত বাড়ছে, যা ভোক্তাদের জন্য বড় চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বাজারে মূল সমস্যাটি হলো বাজার সিন্ডিকেটের বেপরোয়া কার্যকলাপ। সিন্ডিকেটগুলো ক্রমাগতভাবে পণ্যের দাম বাড়াচ্ছে, এবং এর কোনো কার্যকর প্রতিকার দেখা যাচ্ছে না। সরকার নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজার তদারকি করতে একটি বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন করেছে, যা ইতিবাচক পদক্ষেপ হতে পারে, তবে এখনও পর্যন্ত এর কার্যকারিতা সেভাবে প্রতিফলিত হয়নি। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর সীমিত জনবল নিয়ে অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু সেই অভিযানও বাজারে তেমন কোনো প্রভাব ফেলছে না। কিছু ক্ষেত্রে পেঁয়াজ, আলু, ডিম এবং চিনির শুল্ক কমানো হয়েছে, যা পেঁয়াজ ও আলুর দামে কিছুটা প্রভাব ফেলেছে, তবে অন্য পণ্যের ক্ষেত্রে তেমন কোনো পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে না।

এমন পরিস্থিতিতে সরকারকে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। বাজার সিন্ডিকেটের দমন, উৎপাদন বৃদ্ধির উদ্যোগ এবং ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণে আরও মনোযোগী হওয়া জরুরি। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে বাজারকে প্রতিযোগিতামূলক করতে হবে, যাতে কিছু কোম্পানি বা আমদানিকারকের হাতে বাজার নিয়ন্ত্রিত না থাকে। সরবরাহব্যবস্থায়ও সংস্কার আনতে হবে। বাজার তদারকির জন্য প্রয়োজনীয় পাকা রসিদের ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে এবং লেনদেনের স্বচ্ছতা আনতে হবে। চাঁদাবাজি ও মধ্যস্বত্বভোগীদের নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্তি পেতে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

সাধারণ জনগণের স্বার্থে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য কমাতে এবং ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে কৃষক সমবায়ভিত্তিক বিপণন ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে। এভাবে সরাসরি উৎপাদক থেকে ভোক্তার কাছে পণ্য পৌঁছাতে মধ্যস্বত্বভোগীদের ভূমিকা কমানো সম্ভব হবে। এছাড়া, পণ্যের চাহিদা, উৎপাদন এবং সরবরাহের পরিসংখ্যান আরও বিশ্বাসযোগ্য করতে হবে, যাতে বাজার সম্পর্কে সঠিক তথ্য পাওয়া যায় এবং যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা যায়।

সরকারের সামনে এখন বড় চ্যালেঞ্জ হলো—এই মূল্যবৃদ্ধির লাগাম টেনে ধরা এবং বাজার পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা। সাধারণ জনগণের আশা, সরকার খুব শিগগিরই কার্যকর সিদ্ধান্ত নেবে, যা বাস্তবে পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাবে।


লেখক : খলিলুর রহমান সজল, নির্বাহী পরিচালক, ভলান্টারি কনজিউমারস ট্রেনিং অ্যান্ড অ্যাওয়ারনেস সোসাইটি (ভোক্তা)

Tags

- Advertisement -