নতুন বাণিজ্য কৌশলে আরসেপে যুক্ত হতে চায় বাংলাদেশ

বাংলাদেশের সরকার দেশের বাণিজ্য কৌশলে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের পথে এগোচ্ছে। ভারতের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে আলোচিত কম্প্রেহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ এগ্রিমেন্ট (সেপা) আপাতত সরিয়ে রেখে সরকার এখন চীনের নেতৃত্বাধীন বিশ্বের বৃহত্তম বাণিজ্যিক জোট রিজিওনাল কম্প্রেহেনসিভ পার্টনারশিপ এগ্রিমেন্ট (আরসিইপি) এ যুক্ত হওয়ার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে। এই উদ্যোগের মাধ্যমে বাংলাদেশ বৈশ্বিক বাণিজ্যে নতুন মাত্রা যোগ করতে প্রস্তুত।

সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, চলতি সপ্তাহেই আরসিইপি’র সদস্যপদের জন্য আনুষ্ঠানিক আবেদন জমা দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। এছাড়া, অন্যান্য দেশগুলোর সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) সম্পাদনের প্রস্তুতিও চলছে। বাণিজ্য সচিব মো. সেলিম উদ্দিনের মতে, প্রধান উপদেষ্টার সম্মতির ভিত্তিতে এই প্রক্রিয়া শুরু করা হচ্ছে এবং এর মধ্য দিয়ে জাপান, চীন, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুরের মতো দেশগুলোর সঙ্গে নতুন করে এফটিএ স্বাক্ষরের আলোচনা ত্বরান্বিত হবে। তবে ভারতের সঙ্গে সেপা স্বাক্ষরের বিষয়ে আপাতত কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না।

আরসেপ ১৫টি সদস্য রাষ্ট্রের একটি বিশাল বাণিজ্যিক জোট, যার মোট জনসংখ্যা ২৩০ কোটি এবং বাজারের আকার ২৬.৩ ট্রিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে রয়েছে অস্ট্রেলিয়া, চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, থাইল্যান্ডসহ পূর্ব এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশের নাম। এই বাণিজ্য জোটে যুক্ত হতে হলে বাংলাদেশকে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে পৃথকভাবে আলোচনা করতে হবে এবং এই প্রক্রিয়ায় ২ থেকে ৩ বছর সময় লাগতে পারে।

বাণিজ্য সচিব আশাবাদ ব্যক্ত করে জানান, আরসেপের সদস্য হওয়ার আগেই জাপানের সঙ্গে এফটিএ সম্পন্ন হতে পারে। একইভাবে, চীনের সঙ্গেও এফটিএ স্বাক্ষরের আলোচনা অব্যাহত থাকবে। যদি আরসেপের সদস্য হওয়ার পরও চীনের সঙ্গে এফটিএ স্বাক্ষর করতে বাংলাদেশের বাড়তি সুবিধা হয়, তাহলে সেই পথেও সরকার এগোতে প্রস্তুত।

অর্থনীতিবিদ ও র‍্যাপিডের চেয়ারম্যান ড. আবদুর রাজ্জাক বলেন, আরসেপে যোগদান বাংলাদেশের জন্য একটি যৌক্তিক সিদ্ধান্ত। তবে এর জন্য আমাদের ট্যারিফ কমানোসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার দরকার, কেননা বর্তমানে বাংলাদেশের ট্যারিফ রেট বিশ্বের মধ্যে অন্যতম সর্বোচ্চ।

ভারতের সঙ্গে সেপা স্বাক্ষরের অগ্রগতি না হওয়ার কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, এটি একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ছিল। সেপার বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে আগামী নির্বাচনের পর রাজনৈতিক সরকারকেই এই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, সেপা স্বাক্ষরের উদ্যোগটি রাজনৈতিক কারণে নেওয়া হয়েছিল, তবে এখন আরসেপে যোগদানের সিদ্ধান্তই অধিকতর যৌক্তিক বলে মনে হচ্ছে। আরসেপে যোগদান করলে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় ৫ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত বাড়তে পারে, যা বৈশ্বিক বাণিজ্যিক সংযোগের ক্ষেত্রে বড় এক পদক্ষেপ।

বাংলাদেশ এলডিসি গ্রাজুয়েশনের পরেও শুল্ক সুবিধা ধরে রেখে এই বাণিজ্য চুক্তির মাধ্যমে বৈশ্বিক বাণিজ্য নেটওয়ার্কে নিজেদের অবস্থান সুসংহত করতে পারবে। তাছাড়া আরসেপে যোগ দিলে দেশের প্রস্তুতকারক খাত, অবকাঠামো উন্নয়ন, প্রযুক্তি খাত এবং আঞ্চলিক সরবরাহ চেইনের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

বাংলাদেশ-চীন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সাধারণ সম্পাদক আল মামুন মৃধা বলেন, আরসেপে যোগদান বাংলাদেশের টেক্সটাইল, তৈরি পোশাক, ওষুধ এবং অন্যান্য পণ্য রপ্তানির সুযোগ বাড়াবে। এতে দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি তরান্বিত হবে এবং বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণও বাড়বে।

সরকারের এই বাণিজ্যিক উদ্যোগ বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ বৈশ্বিক বাণিজ্যে একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে যাচ্ছে, যেখানে দেশটির অর্থনৈতিক সম্ভাবনা বাড়বে এবং আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতার শক্তি আরো বাড়বে।

Tags

- Advertisement -