সড়ক রেল ও নৌপথে পাঁচ বছরে ৩৫ হাজারের বেশি প্রাণহানি

গত পাঁচ বছরে সড়ক, রেলপথ এবং নৌপথে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন দুর্ঘটনায় বাংলাদেশে ৩৫,৩৮৪ জন মানুষ প্রাণ হারিয়েছে এবং আহত হয়েছে ৫৩,১৯৬ জন। এই সময়ে দেশের নিরাপত্তাহীন যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে মানবসম্পদের ক্ষতির আর্থিক মূল্য দাঁড়িয়েছে ৮৭৮.৮৪ বিলিয়ন টাকা। এই চিত্র প্রকাশ করেছে রোড সেফটি ফাউন্ডেশন (আরএসএফ) তাদের সাম্প্রতিক এক গবেষণা প্রতিবেদনে।

২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত মোট ৩২,৭৩৩টি দুর্ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছে। এসব দুর্ঘটনায় মোট নিহতের মধ্যে ৫,১০৩ জন নারী এবং ৪,৭৮৫ জন শিশু ছিল। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ছিল সবচেয়ে প্রাণঘাতী। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ১১,৫৯৩ জন নিহত হয়েছেন। এটি মোট মৃত্যুর ৩২.৭৬ শতাংশ, যা সড়ক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে একটি গভীর উদ্বেগের বিষয়।

মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার পাশাপাশি পথচারীরাও বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। দুর্ঘটনায় ৮,৩৫৮ জন পথচারী নিহত হয়েছে, যা মোট মৃত্যুর ২৩.৬২ শতাংশ। ড্রাইভার এবং তাদের সহকারীদের মৃত্যু হয়েছে ৫,২৬১ জনের, যা মোট মৃত্যুর ১৪.৮৬ শতাংশ। এ থেকে বোঝা যায়, গাড়ি চালকদের জন্য প্রশিক্ষণ এবং নিরাপত্তা নিয়মাবলী অনুসরণ করা কতটা জরুরি।

রেলপথেও দুর্ঘটনার হার চিন্তার বিষয়। ২০১৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ১,২২৮টি রেল দুর্ঘটনা ঘটেছে, যাতে ১,৪০৩ জন নিহত এবং ১,২৬৯ জন আহত হয়েছে। রেলপথের দুর্ঘটনাগুলোর বড় একটি কারণ রেলক্রসিংয়ের নিরাপত্তাহীনতা এবং অপ্রশিক্ষিত রেলকর্মীদের দায়িত্ব পালনে অবহেলা।

এছাড়া নৌপথে দুর্ঘটনার সংখ্যাও কম নয়। এই সময়কালে ৫৮৭টি নৌপথ দুর্ঘটনায় ১,০২১ জন প্রাণ হারিয়েছে। ৩৬৯ জন এখনো নিখোঁজ রয়েছে। এছাড়া নৌপথে আহত হয়েছে ৫৮২ জন। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, দেশের নৌপথের অব্যবস্থাপনা, বিশেষ করে জরাজীর্ণ নৌযানের ব্যবহার এবং পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকাই এই দুর্ঘটনার প্রধান কারণ।

এসব দুর্ঘটনা প্রধানত জাতীয় মহাসড়কগুলোতে বেশি ঘটেছে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে ৩৬.৪৮ শতাংশ দুর্ঘটনা জাতীয় মহাসড়কে, ৩৫.৭৩ শতাংশ আঞ্চলিক সড়কে, ১৫.৪৬ শতাংশ গ্রামীণ সড়কে এবং ১২.১৪ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটেছে নগর সড়কে। এই তথ্যগুলো থেকে স্পষ্ট হয়, দেশের প্রধান সড়কগুলোতে দুর্ঘটনা প্রতিরোধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি হয়ে পড়েছে। বিশেষত দ্রুতগতির যানবাহনের কারণে মহাসড়কগুলোতে দুর্ঘটনা সংখ্যা বেশি, যা সরকার এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বিভাগীয় পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ঢাকা বিভাগে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটেছে, যা মোট দুর্ঘটনার ২৪.৯৬ শতাংশ। এটি দেশের কেন্দ্রীয় অংশের অতিরিক্ত জনসংখ্যা এবং যানবাহনের চাপের সঙ্গে সম্পর্কিত। অন্যদিকে সিলেট বিভাগে সবচেয়ে কম দুর্ঘটনা ঘটেছে, মাত্র ৬.২৯ শতাংশ।

প্রতিবেদনটি দেশের সড়ক, রেল এবং নৌপথের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে এক ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরেছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সড়ক দুর্ঘটনার মূল কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে আইন না মানা, যানবাহনের অপ্রতুল মান নিয়ন্ত্রণ, এবং চালকদের প্রশিক্ষণের অভাব। এছাড়া ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা এবং জনগণের সচেতনতার অভাবও একটি বড় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।

রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের প্রতিবেদনে এসব তথ্য উপস্থাপন করার পাশাপাশি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নও উত্থাপন করা হয়েছে—দুর্ঘটনার হার হ্রাসে এখন পর্যন্ত কার্যকর কোন উদ্যোগ কতটুকু সফল হয়েছে? সড়ক, রেল এবং নৌপথের দুর্ঘটনা প্রতিরোধে সরকার ও প্রশাসনের কার্যকর ভূমিকা এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধির ওপর গুরুত্বারোপ করেছে সংস্থাটি।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, দেশের সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে শুধুমাত্র আইন কঠোর করাই যথেষ্ট নয়, বরং মানসম্মত প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তিগত উন্নয়ন এবং জনসচেতনতার ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এছাড়া ট্রাফিক আইন সঠিকভাবে প্রয়োগ এবং নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করা অপরিহার্য। এর পাশাপাশি, দুর্ঘটনায় আহত বা নিহত ব্যক্তিদের পরিবারকে সহায়তা প্রদানের জন্য একটি স্থায়ী এবং কার্যকর ক্ষতিপূরণ ব্যবস্থা চালু করার প্রয়োজন রয়েছে।

Tags

- Advertisement -