বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলে অবস্থিত সেন্ট মার্টিন দ্বীপ। যদিও আকারে ছোট কিন্তু এর ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব আজকের দিনে অত্যন্ত ব্যাপক। এই দ্বীপের অবস্থান, প্রাকৃতিক সম্পদ এবং আন্তর্জাতিক জলসীমার অবস্থান বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা ও অর্থনীতি থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের উপরও গভীর প্রভাব ফেলছে।
বর্তমানে সেন্ট মার্টিন দ্বীপের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব অনেক বেশি পরিসরে প্রসারিত হয়েছে। বিশেষ করে সমুদ্রসীমা নির্ধারণ, অর্থনৈতিক অঞ্চল (EEZ) সংক্রান্ত বিতর্ক এবং ভারত মহাসাগরে আন্তর্জাতিক শক্তির প্রতিযোগিতার প্রেক্ষাপটে।
সেন্ট মার্টিনের ভূ-গোলিক অবস্থান ও সামরিক গুরুত্ব-
সেন্ট মার্টিন দ্বীপ ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে প্রায় ২৫০ কিলোমিটার এবং মিয়ানমারের ইয়াঙ্গুন থেকে প্রায় ২০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থান করছে। এর অবস্থান ভারত মহাসাগরের প্রবাহকে প্রভাবিত করতে পারে, যা বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ পণ্য পরিবহণ পথ। যেহেতু এ অঞ্চলের জলসীমা নিয়ন্ত্রণকারী দেশগুলোর মধ্যে ভারত এবং চীন রয়েছে। তাই সেন্ট মার্টিন দ্বীপ কৌশলগত দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে নিরাপত্তা এবং বাণিজ্যিক গুরুত্ব বৃদ্ধির জন্য। সেন্ট মার্টিন দ্বীপ একটি ‘স্ট্র্যাটেজিক পয়েন্ট’ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
এছাড়া, মিয়ানমারের সঙ্গে দীর্ঘদিনের সামুদ্রিক সীমার বিরোধের কারণে দ্বীপটি বাংলাদেশের নিরাপত্তা কৌশলে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। যেহেতু সেন্ট মার্টিন দ্বীপ বাংলাদেশের আঞ্চলিক সমুদ্রসীমার মধ্যে পড়ে, এটি দেশের সমুদ্রপথের নিরাপত্তা এবং টহল নিয়ন্ত্রণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
আন্তর্জাতিক জলসীমা এবং অর্থনৈতিক এলাকা-
২০০৯ সালে আন্তর্জাতিক আদালত (ICJ) বাংলাদেশের পক্ষে সমুদ্রসীমা নির্ধারণের রায় দেয়। যার ফলে বাংলাদেশের EEZ ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত হয়। এর ফলে, সেন্ট মার্টিন দ্বীপ বাংলাদেশের জন্য একটি মূল্যবান সামুদ্রিক সম্পদ হয়ে দাঁড়ায়। বিশেষ করে সম্ভাব্য তেল ও গ্যাস অনুসন্ধানের দিক থেকে। এই সমুদ্রসীমার মধ্যে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদ, মাছ ধরার ক্ষেত্র এবং সামুদ্রিক খনিজের প্রাপ্তির সুযোগ রয়েছে। বাংলাদেশ এই দ্বীপের কাছে অবস্থিত সমুদ্র এলাকায় সম্ভাব্য তেল, গ্যাস এবং অন্যান্য খনিজ সম্পদের অনুসন্ধান চালাচ্ছে, যা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে।
মিয়ানমার-বাংলাদেশ সম্পর্ক এবং চীনের প্রভাব-
মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধ, বিশেষ করে সেন্ট মার্টিন দ্বীপের কাছাকাছি এলাকার মালিকানা, মিয়ানমারের সামুদ্রিক দাবি প্রতিষ্ঠার প্রয়াস আরও দৃঢ় করেছে। মিয়ানমার, চীনের সহযোগিতায় দক্ষিণ চীন সাগরে আধিপত্য বিস্তারের লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। সেন্ট মার্টিন দ্বীপের উপর নিয়ন্ত্রণ বা মালিকানা লাভ করলে, বাংলাদেশ শুধু তার সমুদ্রসীমা রক্ষা করতে পারবে না, পাশাপাশি চীনের আধিপত্য বিস্তার প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত পদক্ষেপ নিতে সক্ষম হবে।
পরিবেশ ও টেকসই উন্নয়ন-
সেন্ট মার্টিন দ্বীপের পরিবেশগত গুরুত্বও প্রচুর। এটি একটি প্রবাল দ্বীপ, যার প্রাকৃতিক পরিবেশ অত্যন্ত সংবেদনশীল। অতিরিক্ত পর্যটন, মাটি কাটা, অবকাঠামো নির্মাণ এবং সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্যের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। দ্বীপটির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও প্রতিবেশের সুরক্ষা নিশ্চিত করা বাংলাদেশ সরকারের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। সেন্ট মার্টিনের পরিবেশগত সংকট সমাধান এবং টেকসই পর্যটন উন্নয়নকে প্রধান্য দেওয়া উচিত।
সেন্ট মার্টিন দ্বীপে সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য এবং মাছ ধরার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এখানকার জেলেরা ব্যাপকভাবে মাছ ধরেন এবং প্রবালপ্রাচীরের জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বাসস্থান। যদি এই পরিবেশের ক্ষতি হয়, তবে তা বাংলাদেশের সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য এবং স্থানীয় অর্থনীতিতে বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে।
কূটনৈতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক-
সেন্ট মার্টিন দ্বীপের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব শুধু বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি ভারতের সঙ্গে সম্পর্কেরও একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভারত মহাসাগরে বাণিজ্যিক প্রবাহ এবং নৌ নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য বাংলাদেশের সেন্ট মার্টিন দ্বীপের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের প্রেক্ষাপটে, বাংলাদেশের অবস্থান সেন্ট মার্টিন দ্বীপকে একটি কৌশলগত দৃষ্টিকোণ থেকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে।
বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তন, সমুদ্রস্তরের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রেক্ষাপটেও এই দ্বীপের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব আরো বাড়তে পারে।
সেন্ট মার্টিন দ্বীপের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব কেবল বাংলাদেশের জন্যই নয়, আন্তর্জাতিক স্তরে অতি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ভবিষ্যত, নিরাপত্তা এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এই দ্বীপের ভূমিকা আরও গভীরভাবে বিশ্লেষণ ও মোকাবিলা করা প্রয়োজন। সেন্ট মার্টিনের সঠিক ব্যবস্থাপনা এবং কৌশলগত পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থ রক্ষা এবং আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অবস্থান শক্তিশালী করা সম্ভব।