সরকারি নিষেধাজ্ঞার কারণে ১ ফেব্রুয়ারি থেকে পর্যটকদের প্রবেশ বন্ধ থাকায় দেশের একমাত্র প্রবালসমৃদ্ধ দ্বীপ সেন্টমার্টিনে ফিরে এসেছে নির্জনতা। ফলে দ্বীপের প্রকৃতি যেন নতুন করে প্রাণ ফিরে পাচ্ছে।
পর্যটকশূন্য সৈকতে আবারও দেখা যাচ্ছে ঝাঁকে ঝাঁকে লাল কাঁকড়া। বেড়েছে শামুক-ঝিনুকের বিচরণও। সৈকতের কাছের পানিতে বিভিন্ন প্রজাতির মাছের আনাগোনা বেড়েছে। ডালপালা মেলতে শুরু করেছে কেয়াগাছ। স্থানীয় বাসিন্দারা এবং পরিবেশবিদরা এই পরিবর্তনকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন।
গত বছরগুলোতে ৩১ মার্চ পর্যন্ত পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত থাকলেও এবার ৩১ জানুয়ারির পর থেকে প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়। আগে প্রতিদিন গড়ে পাঁচ হাজারের বেশি পর্যটক দ্বীপে আসতেন, তবে এবার ১ ডিসেম্বর থেকে ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত প্রতিদিন মাত্র দুই হাজার পর্যটককে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল।
পরিবেশ অধিদপ্তরের কক্সবাজার কার্যালয়ের উপপরিচালক জমির উদ্দিন জানান, পর্যটক প্রবেশ বন্ধ থাকায় দ্বীপের পরিবেশ রক্ষায় নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ৫ ফেব্রুয়ারি পরিবেশ অধিদপ্তরের একটি দল ড্রোন ব্যবহার করে দ্বীপের বর্জ্যের অবস্থান শনাক্ত করে। যা ১২ ফেব্রুয়ারি থেকে অপসারণ শুরু হয়। এখন পর্যন্ত ৯৩০ কেজি বর্জ্য সরানো হয়েছে। যার ৯০ শতাংশই চিপস, বিস্কুটের প্যাকেট ও পলিথিন। পাশাপাশি স্থানীয়দের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য একাধিক সভার আয়োজন করা হয়েছে।
দ্বীপের বাসিন্দা ও ব্যবসায়ী আব্দুল মোতালেব জানান, তার দুটি কটেজ থাকলেও সংসারের মূল উপার্জন আসে নারকেল বাগান থেকে। পর্যটকদের অনুপস্থিতিতে ব্যবসার কিছুটা ক্ষতি হলেও দ্বীপের পরিবেশ দেখে মন ভরে যাচ্ছে। সকালে সৈকতে দেখা যায় শামুক-ঝিনুক, নির্ভয়ে বিচরণ করছে লাল কাঁকড়া। তার মতে, এটি ২০ বছর আগের সেন্টমার্টিনের চিত্রের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে।
স্থানীয় আরেক বাসিন্দা আব্দুল আজিজ বলেন, আগে পর্যটকবাহী জাহাজের চলাচলের কারণে সাগরের পানি ঘোলাটে হয়ে যেত। প্লাস্টিক বর্জ্যে ভরে যেত সমুদ্রতীর। এখন জাহাজ চলাচল বন্ধ থাকায় সমুদ্রের পানি স্বচ্ছ নীল রঙ ধারণ করেছে, প্লাস্টিক বর্জ্য প্রায় নেই বললেই চলে।
সেন্টমার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য নাজির হোসেন বলেন, দিয়ারমাথাসহ দ্বীপের দক্ষিণাংশে পাথুরে সৈকতে নতুন প্যারাবন গড়ে উঠছে। পর্যটকদের অনুপস্থিতিতে গাছগুলো দ্রুত বেড়ে উঠছে, যা দ্বীপের পরিবেশের জন্য ইতিবাচক।
পরিবেশবিষয়ক সংগঠন ‘ইয়ুথ এনভায়রনমেন্ট সোসাইটি (ইয়েস)’ এর চেয়ারম্যান মুজিবুল হক বলেন, সেন্টমার্টিনের মধ্যভাগে পাকা সড়ক থাকলেও দিয়ারমাথা ও ছেঁড়া দ্বীপ যেতে সৈকতের বালুচর ব্যবহার করতে হয়। আগে পর্যটকদের যাতায়াতের কারণে লাল কাঁকড়া, শামুক-ঝিনুকসহ সামুদ্রিক প্রাণীরা মারা যেত। এখন পর্যটক না থাকায় এসব প্রাণী আবার বংশবিস্তার করতে পারছে।
তিনি আরও জানান, দ্বীপে হোটেল-রিসোর্টের সংখ্যা বাড়ায় পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। তবে বর্তমানে স্থানীয়রা জীবিকার জন্য মাছ ধরা, শুঁটকি তৈরি, সবজি ও তরমুজ চাষ এবং নারকেল-ডাব বিক্রির ওপর নির্ভর করছেন।
সেন্টমার্টিনে কচ্ছপের ডিম সংরক্ষণে কাজ করা বেসরকারি সংস্থা ‘নেকম’-এর সহকারী প্রকল্প পরিচালক ড. শফিকুর রহমান বলেন, পর্যটন সীমিত করায় দ্বীপের পরিবেশের উন্নতি হয়েছে। ডিসেম্বরে ও জানুয়ারিতে পর্যটকদের উপস্থিতি সীমিত থাকায় প্রবাল আহরণ বন্ধ ছিল। সৈকতে পর্যটকদের অতিরিক্ত ভিড় না থাকায় মা কাছিম নির্ভয়ে ডিম পাড়তে পারছে। ফলে কচ্ছপের পাশাপাশি লাল কাঁকড়া, শামুক-ঝিনুকের সংখ্যাও বেড়েছে।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে দ্বীপের ভারসাম্য রক্ষায় পর্যটক সংখ্যা আরও নিয়ন্ত্রণে আনার পরিকল্পনা চলছে। দ্বীপে যানবাহনের চলাচল সীমিত করা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় কড়াকড়ি আরোপ এবং প্রবালসহ সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য রক্ষায় নতুন নিয়ম চালু করার বিষয়েও আলোচনা চলছে।
দীর্ঘদিনের অব্যবস্থাপনার পর পর্যটন নিষেধাজ্ঞার কারণে সেন্টমার্টিন তার প্রকৃত সৌন্দর্য ফিরে পাচ্ছে। তবে এই পরিবর্তন ধরে রাখতে পরিকল্পিত ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা জরুরি বলে মনে করছেন পরিবেশবিদরা।