প্রতি বছরই বঙ্গোপসাগরে মাছের প্রাকৃতিক উৎস সংরক্ষণ এবং টেকসই মৎস্য আহরণের জন্য মাছ ধরার ওপর সরকারি নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। এবারও ১৫ এপ্রিল মধ্যরাত থেকে শুরু হয়েছে এই নিষেধাজ্ঞা, যা চলবে আগামী ১১ জুন মধ্যরাত পর্যন্ত। এই নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়ন করা হয়েছে সাগরের মৎস্য সম্পদ রক্ষা এবং মাছের উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য। তবে, এই নিষেধাজ্ঞা সরাসরি প্রভাব ফেলেছে ভোলার ৬৫ হাজার নিবন্ধিত সাগরগামী জেলের ওপর, যারা বর্তমানে কর্মহীন হয়ে পড়েছেন।
বিষয়টি নিয়ে ভোলার জেলেরা জানিয়েছেন, মৎস্য আহরণের নিষেধাজ্ঞার কারণে তারা এখন আর সাগরে মাছ ধরতে যেতে পারবেন না, যার ফলে তাদের আয়ের উৎস পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। গত কয়েকদিন ধরে তারা তীরে ফিরে আসছেন এবং তাদের ফিশিংবোটের সব সরঞ্জামাদি নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিচ্ছেন। অনেকেই বোট মেরামত শুরু করেছেন, আবার কিছু জেলে ফিশিংবোট থেকে জাল নামিয়ে নিচ্ছেন, যাতে নিষেধাজ্ঞার সময় শেষ হলে সাগরে ফিরে যেতে পারেন।
এদিকে, কর্মহীন হয়ে পড়া এসব জেলেরা সরকারের কাছ থেকে খাদ্য সহায়তা এবং ঋণের কিস্তি বন্ধ রাখার আবেদন জানিয়েছেন। তারা বলেন, “আমরা এখন বেকার হয়ে পড়েছি, আয় নেই, আর ঋণের কিস্তি পরিশোধ করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। বিশেষ করে এনজিওদের কিস্তি পরিশোধ করতে না পারলে তারা চাপ দেবে, তাই সরকারের কাছে আমাদের আবেদন—কিছু দিন ঋণের কিস্তি বন্ধ রাখা হোক।”
সরকারি খাদ্য সহায়তার জন্যও তাদের দাবি রয়েছে। তারা বলেন, “যতদিন সাগরে মাছ ধরা বন্ধ থাকবে, ততদিন আমরা আর্থিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ব। তাই, আমাদের জন্য বরাদ্দকৃত চাল যেন দ্রুত সরবরাহ করা হয়। আমরা জানি, অনেক প্রকৃত জেলে সরকারি চাল থেকে বঞ্চিত হয়েছেন, তাই আশা করি, এবার এমনটা হবে না।”
এ বছর, বিশেষভাবে, ভোলার জেলেরা সন্তুষ্ট হয়েছেন যে, ভারতের সাথে মিলিয়ে সাগরে মাছ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞার সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে। তারা জানান, বিগত বছরগুলোতে, যখন বাংলাদেশে মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞা ছিল, তখন ভারতের জেলেরা এসে সাগরে মাছ ধরত, যা তাদের জন্য একটি বাড়তি চাপ সৃষ্টি করেছিল। তবে এবার ভারত ও বাংলাদেশ উভয়েরই একযোগে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ায়, এই ধরনের সমস্যা আর থাকবে না।
ভোলা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা বিশ্বজিৎ কুমার দেব ঢাকা পোস্টকে জানিয়েছেন, “আমরা ৫৮ দিনের নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়ন করতে ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছি। সরকারিভাবে জেলেদের সহায়তা নিশ্চিত করতে আমরা সচেতনতা সভা করেছি এবং একে অপরকে সতর্ক করার জন্য আমাদের নজরদারি কার্যক্রম বাড়ানো হয়েছে। আমরা বরফ কলগুলোকে নির্দেশ দিয়েছি যাতে তারা কোনো সাগরগামী ফিশিংবোটকে বরফ সরবরাহ না করে। একই সঙ্গে চেকপোস্ট বসানো এবং ঘাটগুলোর তদারকি আরও কঠোর করা হয়েছে।”
তিনি আরও জানান, জেলা টাস্কফোর্সের সাথে মিটিং হয়েছে এবং এই নিষেধাজ্ঞাকালীন সময়ে জেলা প্রশাসন, উপজেলা প্রশাসন, নৌবাহিনী, কোস্টগার্ড, নৌপুলিশ এবং মৎস্য বিভাগ একযোগে কাজ করবে। তিনি বলেন, “সরকারি খাদ্য সহায়তার চালের জন্য আমাদের অর্ডার শিগগিরই আসবে এবং তখন প্রতি মাসে ৪০ কেজি চাল বিতরণ করা হবে।”
এছাড়া, ভোলা জেলার মৎস্য বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, জেলায় মোট নিবন্ধিত জেলের সংখ্যা ১ লাখ ৭০ হাজার ২৮৩ জন, যার মধ্যে সাগরগামী জেলের সংখ্যা ৬৫ হাজার। এই জেলেরা যখন একদিকে কর্মহীন, তখন তারা সরকারি সহায়তা না পেলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
এ বছর ৫৮ দিনের নিষেধাজ্ঞা সাগরের মৎস্য সম্পদ রক্ষা এবং মাছের প্রাকৃতিক জীববৈচিত্র্য বজায় রাখার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। তবে, এই সময়ে মৎস্যজীবীদের জন্য সরকারের সহায়তা এবং তাদের অর্থনৈতিক সুরক্ষা নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি।