লন্ডনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের বৈঠকের পর জানানো হয়েছিল—২০২৬ সালের রমজান শুরুর আগেই জাতীয় নির্বাচন আয়োজন সম্ভব। তবে তা সম্ভব হবে সংস্কার ও জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচারকাজে যথেষ্ট অগ্রগতি হলে। এ লক্ষ্যে অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা চালাচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার ও জাতীয় ঐকমত্য কমিশন।
কিন্তু কমিশন এখনো মৌলিক কিছু বিষয়ে রাজনৈতিক ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করতে পারছে না। বিশেষ করে তিনটি বিষয়ে আলোচনা আটকে আছে। ফলে আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে স্পষ্টতা আসছে না।
প্রকাশ্য ও পর্দার আড়ালের সংলাপে দেখা যাচ্ছে, নির্বাচন কীভাবে, কখন হবে—এ নিয়ে দলগুলোর অবস্থান এখনো বিপরীতমুখী। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজও এই দূরত্বের কথা স্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন বিষয়ে অগ্রগতি হলেও আশাব্যঞ্জক অগ্রগতি কিছুটা পিছিয়ে রয়েছে।’
বিএনপি ও সমমনা দলগুলো জাতীয় নির্বাচন আগে চায়। বিপরীতে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) চাইছে আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন। তাদের ধারণা, স্থানীয় পর্যায়ে তারা ভালো করতে পারবে। এতে বিএনপির একক বিজয়ের সম্ভাবনাও কমবে।
এছাড়া নির্বাচন কমিশনের সক্ষমতা যাচাই এবং প্রশাসনের ভূমিকা নিরীক্ষার সুযোগও তৈরি হবে বলে মনে করছে তারা।
বিএনপি চায় দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদে নিম্নকক্ষে সরাসরি ভোট, আর উচ্চকক্ষে আসন বণ্টন হোক নিম্নকক্ষে অর্জিত আসনের অনুপাতে। জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলন চাইছে—উভয় কক্ষে দলীয় মোট ভোটের ভিত্তিতে আসন বরাদ্দ। এনসিপি চায়, নিম্নকক্ষে সরাসরি ভোটে এবং উচ্চকক্ষে দলীয় ভোটের অনুপাতে প্রতিনিধিত্ব।
স্থানীয় সরকার নির্বাচনের পর জাতীয় নির্বাচন হলে জামায়াত, ইসলামী আন্দোলন ও এনসিপির উচ্চকক্ষে প্রভাবশালী হওয়ার সম্ভাবনা দেখছে এই তিন দল।
গত শুক্রবার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ইসলামী আন্দোলনের সমাবেশে স্থানীয় নির্বাচন ও আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের দাবি তুলে ধরা হয়। এতে অংশ নেয় জামায়াত, এনসিপি ও সমমনারা। বিএনপিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি, কারণ তাদের অবস্থান ভিন্ন।
জামায়াত আমির ডা. শফিকুর রহমান মনে করেন, আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হলে নির্বাচন কমিশনের দক্ষতা যাচাই করা সম্ভব হবে।
সব রাজনৈতিক দল প্রায় একমত—আগামী নির্বাচনের আগে জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহাল প্রয়োজন। সরকারও আশা দিয়েছিল, মৌলিক বিষয়ে ঐকমত্য হলে আগামী জুলাই মাসের শুরুতে ‘জুলাই সনদ’ দেওয়া সম্ভব হবে।
তবে কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজ জানিয়েছেন, দলের অনড় অবস্থানের কারণে ১৬ জুলাই আবু সাঈদের মৃত্যুবার্ষিকীতে ঘোষণাপত্র প্রকাশ নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।
লন্ডন থেকে ফেরার পর মুহাম্মদ ইউনূস প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। সেখানে সীমিত পরিসরে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের সম্ভাবনা নিয়েও আলোচনা হয়। বিএনপি এ আলোচনার বিবরণ প্রকাশের দাবি জানিয়েছে।
সরকারের ভেতরে-বাইরেও অনেকে মনে করছেন, কিছু মহল অনানুষ্ঠানিকভাবে সংলাপের গতিপথ নিয়ন্ত্রণ করছে। এতে গতি হারাচ্ছে ঐকমত্য প্রক্রিয়া।
ঐকমত্য কমিশন চায়, সাংবিধানিক পদে নিয়োগের জন্য সার্চ কমিটি গঠনের বিধান সংবিধানে যুক্ত হোক। জামায়াত, ইসলামী আন্দোলন ও এনসিপি এ প্রস্তাবকে সমর্থন করছে। কিন্তু বিএনপির মতে, এতে নির্বাহী বিভাগ পঙ্গু হয়ে যাবে।
সংলাপে বিএনপির প্রতিনিধি সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হবে, তা সনদে আনা যায়। কিন্তু সব প্রস্তাব এখনই মানতে হবে, এই ধারণা থেকে সরে আসতে হবে।’
জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. তাহেরের মতে, সার্চ কমিটি থাকলেও এতদিন নিয়োগ হতো প্রধানমন্ত্রীর গোপন তালিকা থেকে। সংবিধানে যুক্ত হলে স্বচ্ছতা বাড়বে।
মির্জা আব্বাস বলেন, ‘নানা দাবি তুলে নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এতে জাতির ক্ষতি হবে।’ অন্যদিকে, এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম অভিযোগ করেন, সরকার ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে ঘোষণাপত্র দিতে চেয়েছিল, কিন্তু বাস্তবে কিছুই হয়নি। তাই ৩ আগস্ট এনসিপির উদ্যোগে ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ পাঠ করা হবে।
গত ১০ মে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল ৩০ দিনের মধ্যে ঘোষণাপত্র দেওয়ার কথা বলেছিলেন।