২০২৪ সালের ৫ আগস্ট—বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় দিন। ছাত্র-জনতার ঐক্যবদ্ধ গণঅভ্যুত্থানে পতন ঘটে দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ সরকারের। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে চলে যান ভারতে, আত্মগোপনে চলে যান তার মন্ত্রিসভার সদস্য, উচ্চপদস্থ আমলারা, বিচারপতিরা, এমনকি বায়তুল মোকাররমের খতিব পর্যন্ত। কিন্তু সবচেয়ে নাটকীয় ঘটনা ঘটেছিল দেশের সবচেয়ে বড় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী—পুলিশকে ঘিরে।
সরকার পতনের আগের কয়েক মাসে, বিশেষ করে জুলাই-আগস্টে, সরকারবিরোধী ছাত্র ও জনতার বিক্ষোভ দমন করতে গিয়ে পুলিশ ব্যাপকভাবে গুলি চালায়। এতে নারী, শিশুসহ প্রাণ হারান অন্তত দেড় হাজার মানুষ। আহত হন ৩০ হাজারেরও বেশি। সেই রক্তাক্ত অধ্যায়ের পর গণবিরোধী দমন-পীড়নের প্রতিক্রিয়ায় জনতার আক্রোশে দিশেহারা হয়ে পড়ে পুলিশ বাহিনী।
দুই লাখ সদস্যের এই বাহিনীর অনেকে তখন ইউনিফর্ম খুলে পালিয়ে যান, কেউ আত্মগোপনে, কেউ দেশ ছেড়ে বিদেশে পাড়ি জমান। আইজিপি থেকে কনস্টেবল—সবাইকে ছুঁয়ে যায় আতঙ্ক। দেশের অধিকাংশ থানা ও পুলিশ স্থাপনাগুলো হয়ে পড়ে কার্যত ফাঁকা। কোথাও কোথাও হাতে গোনা কয়েকজন পুলিশ সদস্য থাকলেও তারা ছিলেন সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয়, আতঙ্কগ্রস্ত।
তিন দিন পর, ৮ আগস্ট, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর ধীরে ধীরে শুরু হয় পুলিশের ঘুরে দাঁড়ানোর প্রক্রিয়া। সেনাবাহিনী তখন দেশের আইনশৃঙ্খলার ভার নেয় এবং পুলিশের কর্মস্থলে ফেরার জন্য সময় বেঁধে দেয় সরকার।
কিন্তু ততদিনে পরিস্থিতি অনেক বদলে গেছে। পুলিশের প্রতি মানুষের আস্থা তলানিতে, ক্ষোভ চরমে। অনেক পুলিশ কর্মকর্তা ফিরে না এসে বরং স্থায়ীভাবে আত্মগোপন বা দেশত্যাগ করে। সরকারের দেওয়া সময়সীমার মধ্যেও ১৮৭ জন পুলিশ সদস্য কাজে ফেরেননি। এদের মধ্যে ৫১ জনকে অবসরে পাঠানো হয়, ১৭ জনকে বরখাস্ত এবং অনেককে গণহত্যার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়। এখনও ১১৬৮ জন পুলিশ সদস্য ওই সময়ের দায়ে মামলার মুখে।

এমন ভয়াবহ এক সংকট কাটিয়ে ধীরে ধীরে পুলিশ আবার তাদের অবস্থানে ফিরে আসে। এ পথ সহজ ছিল না। পুলিশের সংস্কার নিয়ে কাজ করা মানবাধিকারকর্মী এএসএম নাসির উদ্দিন এলান বলছেন, “৫ আগস্টের পর পুলিশ একেবারে ভেঙে পড়েছিল। সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়ানো কঠিন ছিল। তবে বর্তমানে নেতৃত্বে যারা আছেন তারা অনেক সচেতন ও দক্ষ।”
পুলিশ সদর দফতরের মুখপাত্র এআইজি ইনামুল হক সাগরও সেই সংকটময় মুহূর্তের কথা অকপটে স্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, “চ্যালেঞ্জ ছিল, কিন্তু আন্তরিকতার সঙ্গে আমরা সেটাকে মোকাবিলা করেছি। পুলিশ এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি পেশাদারভাবে কাজ করছে।”
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, “বর্তমান পুলিশ আগের তুলনায় অনেক মানবিক ও দায়িত্বশীল। সেই পুরনো ভয়ঙ্কর চেহারাটা আর নেই। এখনকার পুলিশ আরও বাস্তববাদী ও গণমুখী হয়ে উঠেছে।”
তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ২০২৪ সালের সেই রক্তাক্ত গণআন্দোলন শুধু একটি সরকার পতন নয়, বরং গোটা আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থার ওপর গভীর প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছে।
এখন সময় এসেছে দীর্ঘদিনের অবহেলিত পুলিশ সংস্কারকে কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করার। যেন আবার কোনো ৫ আগস্ট না আসে, না পুলিশ পালাতে বাধ্য হয়, না জনগণের আস্থা এভাবে ভেঙে পড়ে।
বাংলাদেশের গণতন্ত্র, আইনশৃঙ্খলা ও জননিরাপত্তার ভবিষ্যৎ অনেকটাই নির্ভর করছে এই পুলিশ বাহিনীর ঘুরে দাঁড়ানোর ক্ষমতার ওপর। আর সে পথে চলা এখনও চলছে—ধীরে, কিন্তু দৃঢ়ভাবে।