রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় অচেনা লাশের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। মানবাধিকার সংস্থা মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের (Manabadhikar Songshkriti Foundation–MSF) সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সারাদেশে ৪৬১টি অজ্ঞাতনামা লাশ উদ্ধার হয়েছে। আগের বছর একই সময়ে এই সংখ্যা ছিল ৩৭৩, আর ২০২৩ সালে ছিল ২৫০।
সংস্থাটি জানায়, শুধু সেপ্টেম্বর মাসেই ৫২টি অজ্ঞাত লাশ উদ্ধার করা হয়, যার মধ্যে দু’একটি বাদে অধিকাংশের পরিচয় মেলেনি। এই ক্রমবর্ধমান প্রবণতায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন সমাজবিজ্ঞানী, অপরাধতত্ত্ববিদ ও মানবাধিকারকর্মীরা। তাঁদের মতে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এসব মৃত্যু হত্যাকাণ্ডের ফল, যার পেছনে রয়েছে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক বা ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব।
মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধতত্ত্ব ও পুলিশ বিজ্ঞান বিভাগের ডিন অধ্যাপক মো. ওমর ফারুক বলেন, অজ্ঞাত ও দাবিহীন লাশের সংখ্যা উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে। এটি দেশের সামগ্রিক আইনশৃঙ্খলার চিত্রের প্রতিফলন। তাঁর ভাষায়, “অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত বিবাদের সুযোগ নিয়ে অনেক অপরাধী এখন হত্যাকাণ্ড ঘটাচ্ছে, কারণ তারা জানে—এই সময়ে শাস্তি পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।”
অধ্যাপক ফারুকের মতে, এসব হত্যাকাণ্ড অনেকাংশেই পরিকল্পিত এবং এতে জড়িত পেশাদার অপরাধীরা। “তারা লাশ ফেলে যায় এমন জায়গায়, যেখানে উদ্ধার হতে দেরি হয়, ফলে পচে যাওয়ার কারণে শনাক্তকরণ কঠিন হয়ে পড়ে,” তিনি বলেন।
অধিকাংশ অচেনা লাশ নদী বা খালে ভাসমান অবস্থায়, সড়কপথ বা সেতুর নিচে, রেললাইনের পাশে, মাঠে কিংবা নির্জন জায়গায় পড়ে থাকতে দেখা যায়।
গত ৫ অক্টোবর ঢাকার গেন্ডারিয়া রেলস্টেশনের পাশে খোলা জায়গায় একটি নারীর রক্তাক্ত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। গলায় ও শরীরে একাধিক ছুরিকাঘাতের চিহ্ন ছিল। গেন্ডারিয়া থানার ওসি গোলাম মর্তুজা জানান, লাশটি এখনও অচেনা এবং তা দাফনের জন্য আনজুমান মুফিদুল ইসলামকে হস্তান্তর করা হয়েছে। পুলিশের ধারণা, নারীটিকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়, যদিও এ ঘটনায় কাউকে গ্রেপ্তার করা যায়নি।
মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী প্রধান সাইদুর রহমান বলেন, “অপরাধ দমন রাষ্ট্রের দায়িত্ব। অজ্ঞাত লাশ উদ্ধারের মধ্য দিয়ে দায়িত্ব শেষ হয় না। অপরাধী শনাক্ত ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করাই সরকারের কর্তব্য।”
তিনি আরো বলেন, অনেক ক্ষেত্রেই লাশগুলো ধর্মীয় পরিচয় যাচাই না করেই দাফন করা হয়। “এতে স্বচ্ছতা ও দায়বদ্ধতার প্রশ্ন তৈরি হয়,” সাইদুর রহমান মন্তব্য করেন।
আনজুমান মুফিদুল ইসলামের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ঢাকা শহরে ৪৬৮টি দাবিহীন লাশ (অজ্ঞাত ও পরিচিত উভয়ই) দাফন করা হয়েছে। ২০২৩ সালে একই সময়ে এই সংখ্যা ছিল ৩৭৮। শুধুমাত্র সেপ্টেম্বর মাসেই সংগঠনটি ৫৯টি লাশ দাফন করে।
অধিকাংশ বিশ্লেষক মনে করছেন, আগামী জাতীয় নির্বাচনের প্রাক্কালে হত্যাকাণ্ডের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, “নির্বাচন ঘিরে নানা রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগে অনেক অপরাধী নিজেদের স্বার্থে হত্যাকাণ্ড ঘটায়। ১৩তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন (২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি) ঘিরেও এমন আশঙ্কা রয়েছে।”
জ্যোতির্ময়ের মতে, সাম্প্রতিক বেশ কিছু ঘটনায় দেখা গেছে—হত্যাকাণ্ড ঘটানো হচ্ছে এক জায়গায়, আর লাশ ফেলা হচ্ছে অন্য জায়গায়, যাতে শনাক্ত করা কঠিন হয়। তিনি বলেন, “২০২৪ সালের রাজনৈতিক পরিবর্তনের এক বছর পরও দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নত হয়নি। এই অবস্থা চলতে থাকলে অজ্ঞাত লাশের সংখ্যা আরও বাড়বে।”
অচেনা লাশ উদ্ধারের উদাহরণ সম্প্রতি রাজধানীতেও বহু। ২ অক্টোবর রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে তিনটি লাশ উদ্ধার করে পুলিশ—একটি কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পাশে, একটি জাতীয় ঈদগাহের নিকটে, আরেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের কাছ থেকে। এর মধ্যে দুটি লাশের পরিচয় অজানা। পুলিশের ধারণা, তারা পথবাসী ছিল এবং অসুস্থতায় মারা গেছে।
৩ অক্টোবর হযরিবাগের বাসা থেকে নিখোঁজ হন এক তরুণ, ওমর ফারুক মোল্লা। দুই দিন পর তাঁর লাশ ধানমন্ডি লেকে ভাসমান অবস্থায় পাওয়া যায়। সেদিনই আরও তিনটি লাশ উদ্ধার হয় রমনা পার্ক, গেন্ডারিয়া ও হযরিবাগ এলাকা থেকে।
পুলিশ সদর দপ্তরের মিডিয়া ও জনসংযোগ শাখার সহকারী মহাপরিদর্শক সহদাত হোসাইন বলেন, “আমরা প্রযুক্তি ব্যবহার করে লাশের পরিচয় শনাক্তের চেষ্টা করি। যদি না হয়, তবে অস্বাভাবিক মৃত্যুর মামলা (UD case) রুজু করা হয়।” তিনি প্রাথমিক তদন্তে হত্যার ইঙ্গিত নিয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি, তবে বলেন—“যেসব লাশ পরে শনাক্ত হয়, সেগুলো আইনি প্রক্রিয়া শেষে পরিবারকে হস্তান্তর করা হয়। দাবিহীন লাশ আদালতের নির্দেশে দাফন করা হয়।”
আনজুমানের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে মোট ৫৭০টি দাবিহীন লাশ দাফন করা হয়েছিল। সবচেয়ে বেশি, ৮১টি লাশ উদ্ধার হয় জুলাই মাসে, যখন দেশজুড়ে ছাত্রদের কোটা সংস্কার আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে এবং তা আগস্টে বিগত সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে এক গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়। সরকারি হিসাবে, ওই জুলাই–আগস্টের আন্দোলনে অন্তত ৮৩৬ জন নিহত এবং ১৫ হাজারের বেশি মানুষ আহত হয়।
অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক চাপ ও প্রশাসনিক শিথিলতা মিলেই দেশে এক অস্বস্তিকর পরিবেশ তৈরি করেছে, যার সুযোগ নিচ্ছে পেশাদার অপরাধীরা। তারা জানে, এমন সময়ে রাষ্ট্রের নজর অন্যদিকে থাকায় তাদের অপরাধ ধামাচাপা পড়বে।
মানবাধিকারকর্মীদের মতে, অচেনা লাশের এই প্রবণতা শুধু আইনশৃঙ্খলার ব্যর্থতা নয়, বরং নাগরিক নিরাপত্তার প্রতি রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতারও প্রশ্ন তোলে। প্রতিটি অজ্ঞাত লাশ একেকটি ব্যর্থতার প্রতীক—যেখানে ন্যায়ের দাবি চাপা পড়ে অজানার অন্ধকারে।
সূত্র: নিউ এজ

