বিশ্ব রাজনীতির মানচিত্র এখন যেন এক অস্থির দাবার বোর্ড—যেখানে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া আর অন্যান্য শক্তিধর দেশ নিজেদের স্বার্থে নতুন করে ঘুঁটি সাজাচ্ছে। এই পরিবর্তিত ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় বাংলাদেশও পড়তে পারে চাপের মুখে—এমন আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন কূটনীতিক ও বিশ্লেষকরা।
রবিবার রাজধানীর এক হোটেলে অনুষ্ঠিত একটি সেমিনারে বক্তারা বলেন, দক্ষিণ এশিয়ায় বড় শক্তিগুলোর প্রতিদ্বন্দ্বিতা যেমন বাড়ছে, তেমনি আঞ্চলিক সংঘাতের মাঝখানে ঢাকার কূটনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা এখন আগের চেয়ে বেশি কঠিন হয়ে উঠেছে। তাই “ভূকৌশলগত স্বায়ত্তশাসন” বজায় রাখতে এখনই কৌশলগত প্রস্তুতি নিতে হবে বাংলাদেশকে।
‘Navigating Geopolitical Dynamics: Towards a Korea-Bangladesh Future Partnership’—এই শিরোনামে আয়োজিত সেমিনারটি আয়োজন করে ঢাকাস্থ দক্ষিণ কোরিয়ার দূতাবাস।
শুরুতেই বক্তব্য দেন সাবেক রাষ্ট্রদূত ফারুক সোবহান এবং কোরিয়ার রাষ্ট্রদূত ইয়ং-সিক পার্ক।
দুই পর্বে অনুষ্ঠিত এই আলোচনায় প্রথম অংশে উঠে আসে দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ার ভূরাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ, আর দ্বিতীয় অংশে ছিল কোরিয়া-বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব ও মার্কিন শুল্কনীতির প্রভাব নিয়ে আলোচনা।
বক্তারা বলেন, বিশ্ব এখন দ্রুত সামরিকীকরণের পথে এগোচ্ছে। একসময় যে “নিয়মভিত্তিক বহুপাক্ষিক বিশ্বব্যবস্থা” ছিল, তা ভেঙে পড়ছে। সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ূন কবির বলেন,
“বাংলাদেশ যদি সচেতন না হয়, তাহলে বড় শক্তির প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্যে পড়ে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।”
তিনি আরও বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক সম্পর্কগুলোতে এখন বড় পরিবর্তন ঘটছে, যা বাংলাদেশের স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তার ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলতে পারে। বিভাজনমূলক রাজনীতি ও বাড়তে থাকা অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদ পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে।
বক্তারা উল্লেখ করেন, ডোনাল্ড ট্রাম্পের ক্ষমতায় ফেরা বিশ্ব অর্থনীতিতে নতুন অস্থিরতা তৈরি করেছে। পাল্টাপাল্টি শুল্কের কারণে বৈশ্বিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগে আস্থা কমে যাচ্ছে।
অর্থনীতিবিদ ড. সেলিম রায়হান বলেন,
“বাংলাদেশে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা যেমন ব্যবসায়িক পরিবেশে চাপ তৈরি করছে, তেমনি মার্কিন শুল্কনীতিও বিশ্ববাজারে নতুন সংকট ডেকে আনছে।”
তিনি বলেন, এই অনিশ্চয়তা বিনিয়োগকারীদের সিদ্ধান্তে প্রভাব ফেলছে, যা ভবিষ্যতে প্রবৃদ্ধিতেও আঘাত হানতে পারে।
ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক ড. পারভেজ করিম আব্বাসী বলেন, মার্কিন ‘থিংক টোয়াইস অ্যাক্ট’-এ এমন কয়েকটি ধারা রয়েছে যা তৃতীয় দেশগুলোকে চীন থেকে উন্নত অস্ত্র কিনতে নিরুৎসাহিত করছে। এর বদলে যুক্তরাষ্ট্র নিজের অস্ত্র রপ্তানি বাড়ানোর চেষ্টা করছে।
তিনি বলেন, “এই নতুন বাস্তবতায় বাংলাদেশ ও কোরিয়া চাইলে সেমিকন্ডাক্টর ও প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি খাতে যৌথ উদ্যোগ নিতে পারে।”
সেমিনারের সারসংক্ষেপে বক্তারা একমত হন যে, ভূরাজনৈতিক চাপের এই সময়ে বাংলাদেশকে “নন-অ্যালাইনড” অবস্থান আরও শক্তভাবে বজায় রাখতে হবে।
“কারও পক্ষে বা বিপক্ষে নয়, বরং নিজের স্বার্থেই কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন রক্ষা করতে হবে”—এমন আহ্বান জানান বক্তারা।

