ময়মনসিংহ জেলার ফুলপুর উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রাম নিজ আশাবটে একটি কবরস্থান উন্নয়নকে কেন্দ্র করে জেলা পরিষদের প্রকল্প অনুমোদন নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক তৈরি হয়েছে। ‘সামাজিক কবরস্থান’ নামে উল্লেখ করলেও তদন্তে জানা গেছে, এটি স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব মো. রেজাউল মাকছুদ জাহেদীর পারিবারিক কবরস্থান।
সেই স্থান ঘিরে একই ধরনের আটটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে এবং বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে মোট ২৪ লাখ টাকা। এসব প্রকল্প জেলা পরিষদের ভারপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. কবির হোসেন সরদারের উদ্যোগে বাস্তবায়িত হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
জেলা পরিষদ সূত্র জানায়, সচিবকে ‘সন্তুষ্ট’ রাখতে কবির হোসেন এই প্রকল্পগুলো এগিয়ে নেন। একই সঙ্গে তাঁর বিরুদ্ধে কম্বল বিতরণে নয়ছয়, প্রশাসকের স্বাক্ষর জালিয়াতিসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ তোলা হয়েছে জেলা পরিষদের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পক্ষ থেকে। এসব অভিযোগ স্থানীয় সরকার বিভাগে পাঠানোর পর ২৬ অক্টোবর তাঁর বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয়। পরদিনই তাঁকে ময়মনসিংহ থেকে পটুয়াখালী বদলি করা হয় এবং পরে নতুন আদেশে নেত্রকোনায় নেয়া হয়।
তদন্তকাজে দেখা গেছে, গত ১৮ মে জেলা পরিষদের এক বৈঠকে স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে পাওয়া ৯০ লাখ টাকার বিপরীতে ৩৭টি প্রকল্প নেওয়া হয়। এর মধ্যে ফুলপুর উপজেলার ১০টি প্রকল্পের ৯টিই নিজ আশাবট গ্রামে, যেখানে প্রতিটিতে বরাদ্দ ছিল ৩ লাখ টাকা। এই বরাদ্দের মধ্যে কবরস্থানের সীমানাপ্রাচীর নির্মাণ, সুপেয় পানির জন্য টাইলস, মোটর, ট্যাংক স্থাপন ও নালা তৈরির কাজ অন্তর্ভুক্ত ছিল।
প্রকল্পের তালিকা অনুযায়ী, প্রথম প্রকল্পটি ছিল সচিবের দাদা হাজি শমসের আলীর কবরস্থান উন্নয়ন। আরো ছয়টি প্রকল্প ওই একই কবরস্থানের বিভিন্ন উন্নয়নকাজকে কেন্দ্র করে নেওয়া হয়। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এটি সামাজিক কবরস্থান নয়—বরং সচিব পরিবারের ব্যক্তিগত কবরস্থান। সরেজমিনে ২৬ অক্টোবর দেখা যায়, সেখানে সীমানাপ্রাচীর নির্মাণ, মোটর স্থাপন, পানির ট্যাংক বসানো এবং স্যানিটেশন উন্নয়নকাজ চলছিল। পুরোনো একটি সাইনবোর্ডেও ‘পারিবারিক কবরস্থান’ লেখা রয়েছে।
এই বিতর্ক নিয়ে সচিব মো. রেজাউল মাকছুদ জাহেদী বলেন, তিনি কবরস্থান উন্নয়ন নয় বরং মানুষের জন্য পানি সরবরাহ এবং স্থানীয় পাঞ্জেখানা মসজিদের প্রয়োজনীয় কিছু কাজ করতে বলেছিলেন।
তাঁর ভাষায়, “ছোট কাজ করতে বললাম, আর জেলা পরিষদ ভুলভাবে এটা করে বিশ্রী অবস্থা করেছে। এখন প্রকল্পটি বাদ দিতে বলেছি।” তিনি আরো জানান, অভিযোগ জানার পরই কবির হোসেনকে বদলি করা হয়েছে।
অন্যদিকে, জেলা পরিষদের কম্বল ক্রয়েও গুরুতর অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। প্রায় ৪৯ লাখ ৯৮ হাজার টাকায় ১২ হাজার কম্বল কেনার প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হলেও জেলা পরিষদের উপসহকারী প্রকৌশলীসহ সংশ্লিষ্ট কেউ কোনো কম্বল গ্রহণ করেননি বলে দাবি করেছেন। তবে বিতরণ হয়েছে এমন প্রমাণ হিসেবে কিছু কাগজপত্র জমা দিয়েছেন কবির হোসেন বলে জানিয়েছে জেলা পরিষদ দপ্তর।
এছাড়া প্রশাসকের স্বাক্ষর জাল করে প্রায় ১ কোটি ১৩ লাখ টাকার প্রকল্প অনুমোদনের নথি তৈরির অভিযোগও রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। অভিযুক্ত কবির হোসেন জানান, সব প্রকল্পই মাসিক সভায় অনুমোদনের পর মন্ত্রণালয় হয়ে আসে এবং কোনো সমস্যা থাকলে প্রকল্প পরিবর্তন করা হয়।
এদিকে, জেলা পরিষদের বাজেটে অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের নামে বরাদ্দ দেখিয়ে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে ইতিমধ্যে দুর্নীতি দমন কমিশন তদন্ত শুরু করেছে। বিভাগীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকেও পৃথক তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন জেলা পরিষদের প্রশাসক তাহমিনা আক্তার।

