আগের বছরের মতোই নতুন শিক্ষাবর্ষের বই ছাপাতে আবারও দেখা দিচ্ছে নিম্নমানের কাগজের সমস্যা। কয়েকটি বড় প্রেস রিসাইকলড কাগজ ব্যবহার করছে—এমন অভিযোগ উঠলেও মান নিশ্চিত করতে গেলে নানাভাবে বাধার মুখে পড়ছেন জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) এবং ইন্সপেকশন এজেন্টের কর্মকর্তারা। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গেছে যে, কিছু কর্মকর্তাকে নাকি ভয়ভীতিও দেখানো হচ্ছে।
২০২৬ শিক্ষাবর্ষের জন্য প্রায় ৩০ কোটি বই ছাপা হচ্ছে। এর মধ্যে প্রাথমিকের বই ৯ কোটি এবং ইবতেদায়ি ও মাধ্যমিকের বই মিলিয়ে আরও ২১ কোটি। পুরো কাজের এক-দশমাংশের বেশি মাত্র চারটি প্রেস পেয়েছে—অগ্রণী, কর্ণফুলী, কচুয়া এবং আনোয়ারা প্রিন্টিং প্রেস। প্রায় ২০০ কোটি টাকার বেশি অর্ডার পেয়েছে এ চার প্রতিষ্ঠান, যা একসঙ্গে তিন কোটিরও বেশি বই।
এনসিটিবি চেয়েছিল কার্যাদেশ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই চুক্তি করে ছাপার কাজ শুরু হোক। কিন্তু চারটির মধ্যে দুটি প্রেস শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত কাজ শুরুই করেনি। সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির বই ছাপার চুক্তি তারা করে মাত্র ৪ ডিসেম্বর। এর ফলে এসব বই ফেব্রুয়ারি-মার্চে গিয়ে শেষ হতে পারে। ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচনের ব্যস্ততা থাকবে—এই হিসাব ধরে প্রেসগুলো নাকি মনে করছে নিম্নমানের বই সরবরাহ করলেও নজর এড়ানোর সুযোগ থাকবে।
এনসিটিবির মানদণ্ড অনুযায়ী, প্রাথমিক ও ইবতেদায়ির বইয়ে ৮০ জিএসএম ও ৮৫ ব্রাইটনেস থাকার কথা। মাধ্যমিকের বইয়ে ৭০ জিএসএম ও ৮৫ ব্রাইটনেস বাধ্যতামূলক। তবু অভিযোগ উঠেছে—প্রাথমিকের চাপ থাকায় সেখানে মান কিছুটা নিয়ন্ত্রিত হলেও ইবতেদায়ি ও মাধ্যমিকের বইয়ে ব্যবহৃত হচ্ছে কম জিএসএমের কাগজ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাজারে মানসম্পন্ন কাগজের দাম প্রতি টন এক লাখ ১৫ হাজার টাকার মতো হলেও অগ্রণী ও কর্ণফুলী প্রেস কিনছে ৯০ হাজার টনের কাগজ, যার ৩০ থেকে ৪০ শতাংশই রিসাইকলড। ফলে ইবতেদায়ির জন্য তারা যে বই সরবরাহ করেছে, সেগুলোর ওজন ৮০ জিএসএম হওয়ার কথা থাকলেও পাওয়া যাচ্ছে ৬৫-৭০ জিএসএম। আর মাধ্যমিকের বইয়ে ৭০ জিএসএমের জায়গায় পাওয়া যাচ্ছে ৬০-৬৩ জিএসএম। ব্রাইটনেসও মানদণ্ডের নিচে।
এমনকি পরিদর্শনে গিয়ে বাধা ও হুমকির মুখে পড়ছেন কর্মকর্তারা। নোয়াখালীর দুটি প্রেসে গিয়ে কয়েকজন ইন্সপেকশন কর্মকর্তা নাকি সরাসরি হুমকির সম্মুখীন হন। ভালো মানের কাগজ দেখিয়ে সেখান থেকেই স্যাম্পল নিতে বাধ্য করা হয়। একজন কর্মকর্তা নিম্নমানের স্যাম্পল সংগ্রহের পর ফেরার পথে তাঁর ব্যাগ কেড়ে নেওয়া হয়—যাতে ছিল মূল কাগজের নমুনা ও নথি। এরপর অনেক কর্মকর্তা আর পরিদর্শনে যেতে ভয় পাচ্ছেন।
ইন্সপেকশন এজেন্ট কন্ট্রোল ইউনিয়ন বিডির প্রজেক্ট হেড রাফি মাহমুদ বিপ্লব বলেন, “মানের ব্যাপারে কোনো ছাড় দিই না। কিন্তু কেউ যদি কম দামের কাগজ ব্যবহার করে, তার বই নিম্নমানের হবেই। ধরা পড়লেই ব্যবস্থা নেব।”
অভিযোগ আরও গুরুতর। বলা হচ্ছে, এনসিটিবির অ্যাকাউন্টস ও পাঠ্যপুস্তক শাখার কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী নাকি এ সিন্ডিকেটের সঙ্গে যোগসাজশ করে কাজ করছেন। নিম্নমানের বইকেও ভালো দেখিয়ে রিপোর্ট দেন। রাজনৈতিক পরিচয়ও ব্যবহার করে চাপ সৃষ্টি করেন।
আগেও অভিযোগ উঠেছিল। হবিগঞ্জের মাধবপুরে অগ্রণী প্রেস করা প্রাক-প্রাথমিকের বই নিম্নমানের হওয়ায় উপজেলা শিক্ষা অফিস তা ফেরত পাঠায়। আবার মাধ্যমিক পর্যায়ে আনোয়ারা ও কচুয়া প্রেসের সরবরাহ করা বইও শেষ পর্যন্ত বাতিল করা হয়।
তদন্তে উঠে এসেছে—অগ্রণী প্রেসের মালিক কাউসার-উজ-জামান রুবেল এবং কর্ণফুলী প্রেসের মালিক হাসান-উজ-জামান রবিন দুই ভাই। তাঁদের ভগ্নিপতি এসএম হুমায়ুন কচুয়া ও আনোয়ারা প্রেসের মালিক। পূর্ব সরকার আমলে ক্ষমতাসীন শীর্ষ মহলের প্রভাব ব্যবহার করে তাঁরা এই ব্যবসা বড় করেন। গত আট বছরে প্রায় ৪০০ কোটি টাকার বই ছাপার অর্ডার পায় তারা, অভিযোগ অনুযায়ী যেখান থেকে কয়েকশ কোটি টাকাই লোপাট হয়েছে নিম্নমানের বই দিয়ে।
অভিযুক্তরা অবশ্য অভিযোগ অস্বীকার করছেন। কর্ণফুলী প্রেসের মালিক দাবি করেন—“আমরা স্পেসিফিকেশন অনুযায়ীই বই ছাপছি, পরীক্ষাতেও মান ঠিক পাওয়া গেছে।” অন্যদিকে কচুয়া ও আনোয়ারা প্রেসের মালিকও একই দাবি করেছেন।
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলেছেন—কাগজের জিএসএম কম হলে বই টেকসই থাকে না। ছয়-সাত মাসেই পাতার ভাঁজ ছিঁড়ে যায়। ব্রাইটনেস কম হলে শিশুদের চোখে চাপ পড়ে, সমস্যা তৈরি হতে পারে। তাই মানদণ্ডের নিচে নামার কোনো সুযোগ নেই।
অভিজ্ঞরা আরও বলছেন—২০২৫ শিক্ষাবর্ষেও এই চার প্রেসের বইয়ের ৮০ শতাংশই ছিল নিম্নমানের। তদন্ত শুরু হলেও পরে রহস্যজনকভাবে থেমে যায়। তাই এ বছরও ব্যবস্থা নেওয়া না হলে একই চক্র আবারও পার পেয়ে যাবে।
বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতির সাবেক সভাপতি তোফায়েল খান বলেন, “কিছু মিল থেকে খারাপ কাগজ এনে কিছু প্রেস মাধ্যমিকের বই ছাপছে—এ তথ্য আমাদের কাছে আছে। আগেও করেছে, শাস্তি না হওয়ায় তারা নির্ভয়ে একই কাজ করছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও এনসিটিবিকে এখনই কঠোর হতে হবে।”

