সপ্তাহ শেষ হওয়ার আগেই জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হতে পারে—এমনই আভাস মিলছে রাজনৈতিক সূত্রে। তফসিল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই ভোটের মাঠে পুরোপুরি নেমে পড়বে রাজনৈতিক দলগুলো। কিন্তু এর মধ্যেই একটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে উঠছে—এবারের নির্বাচনে এখনো তেমন কোনো বড় মেরুকরণ দেখা যাচ্ছে না। যেসব দল কথায় কথায় জোটের বার্তা দিচ্ছিল, তাঁদের মধ্যেও স্পষ্ট কোনো সমঝোতা গড়ে ওঠেনি।
বিএনপি ও তাদের আন্দোলন–মিত্রদের দিকেই প্রথমে নজর যায়। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আগ পর্যন্ত বিভিন্ন ছোট দলকে সঙ্গে নিয়ে যুগপৎ আন্দোলন চালিয়েছিল বিএনপি। সেই ধারাবাহিকতায় দলটি বারবার বলছে—রাজপথের সেই সহযোগীদের নিয়ে তারা নির্বাচনেও অংশ নিতে চায়, এবং জিতলে যৌথভাবে সরকার গঠন করতে চায়। বিএনপির নীতিনির্ধারকেরা জানান, শরিকদের অবদান তাঁরা মূল্যায়ন করবেন, কিন্তু প্রথম ও প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে জয়। জয় ছাড়া জোট বা সমঝোতার সব হিসাবই অর্থহীন।
কিন্তু বাস্তবে পরিস্থিতি একটু জটিল। ২৭২টি আসনে সম্ভাব্য প্রার্থী তালিকা প্রকাশের পরই শরিকদের একাংশ ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। ১২ দলীয় জোট প্রকাশ্যে অভিযোগ তুলেছে—বিএনপি আগে প্রতিশ্রুতি দিলেও শরিকদের সঙ্গে আলোচনা না করেই প্রার্থীর তালিকা ঘোষণা করেছে। তাঁরা বলছেন, তারেক রহমানের দেওয়া আশ্বাস বাস্তবে প্রতিফলিত হয়নি। আগামী সোমবার এ বিষয়ে স্পষ্ট অবস্থান জানাবে জোট।
বিএনপি অবশ্য যুক্তি দিচ্ছে ভিন্ন। দলের ভেতরের নেতারা বলছেন, বাস্তবতা বিবেচনায় আসন সমঝোতা করতে হচ্ছে। নিবন্ধিত শরিক দলের প্রার্থীরা নিজ নিজ প্রতীকে জিততে পারবেন কি না—এ নিয়েও আছে প্রশ্ন। তাই জয় নিশ্চিত করার দিকেই অগ্রাধিকার।
অন্যদিকে ভোটের মাঠে এবার বিএনপির প্রধান প্রতিপক্ষ হিসেবে উঠে এসেছে জামায়াতে ইসলামী। তাঁদের নেতৃত্বে আটটি ইসলামপন্থী দল ইতিমধ্যে একসঙ্গে আন্দোলন করছে। তবে তারাও এখনো আনুষ্ঠানিক নির্বাচনী জোট বা আসন বণ্টনের ঘোষণা দেয়নি। জামায়াতের নেতারা ইঙ্গিত দিয়েছেন—তফসিলের আগেই সমঝোতা সম্পন্ন করে প্রার্থীর চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করা হবে।
এদিকে নতুন আরেক দিকের আলোচনার নাম—জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। শুরু থেকেই অনেকে ভেবেছিলেন, বিএনপি বা জামায়াতের সঙ্গে জোটে যাবে দলটি। কিন্তু এখন তারা বরং মধ্যপন্থী দলগুলোর সঙ্গে সমন্বয় গড়ে তোলার আলাপ করছে। নিজেদের আলাদা শক্তি হিসেবে দাঁড় করিয়ে রাখার কৌশলেই এগোচ্ছে এনসিপি। দলের ভেতরে দুই ছাত্র উপদেষ্টার মতভেদ নিয়েও চলছে নানা আলোচনা। কেউ মনে করছেন, বিএনপির সঙ্গে জোটে গেলে দলটি বড় ক্ষতির মুখে পড়তে পারে; আবার কেউ দেখছেন জামায়াতের দিকে ঝুঁকতে পারার সুযোগ। এই মতভেদে দলটি এখন কিছুটা বিভক্ত।
অন্যদিকে আওয়ামী লীগপন্থী শরিক হিসেবে বহু বছর নির্বাচন করা জাতীয় পার্টিতেও দেখা গেছে বড় ভাঙন। শেখ হাসিনার পতনের পর দলটি দুই ভাগে বিভক্ত হয়। আনিসুল ইসলাম মাহমুদের নেতৃত্বাধীন অংশ নতুন কমিটি গঠন করে আওয়ামী লীগ–ঘনিষ্ঠ জেপির সঙ্গে নির্বাচনী ঐক্য ঘোষণা করেছে। শিগগিরই ‘জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক জোট’ নামে নতুন জোট ঘোষণার প্রস্তুতিও চলছে। এতে ১৬টিরও বেশি দল যুক্ত থাকবে বলে জানা গেছে।
অন্যদিকে জিএম কাদেরের নেতৃত্বাধীন মূল জাতীয় পার্টি এখনো জোট–আলাপ শুরু করেনি। তাদের বক্তব্য—নির্বাচনের সময় এলে জোটে যাওয়ার সুযোগ আসবে, কারণ অনেক আসনে জাপার ভোটই ফল নির্ধারণ করতে পারে।
সবশেষে, বামপন্থী দলগুলোও বসে নেই। নয়টি দল মিলে নতুন জোট ‘গণতান্ত্রিক যুক্তফ্রন্ট’ গড়ার ঘোষণা দিয়েছে। কমিউনিস্ট পার্টি থেকে শুরু করে বিভিন্ন সমাজতান্ত্রিক ও বিপ্লবী ধারার দল এতে যুক্ত হয়েছে। তাঁরা বলছেন, আরও কিছু বাম দল ও নাগরিক সংগঠনকে যুক্ত করে বড় পরিসরের জোট গড়ার চেষ্টা চলছে, এবং দেশের সার্বিক পরিবর্তনের দাবিতে তারা ‘জনতার সনদ’ তৈরি করছে।
সব মিলিয়ে নির্বাচন যতই কাছে আসে, ততই জোট রাজনীতির জটিলতা যেন বাড়ছে। কেউ জোটভেঙে নতুন জোট করছে, কেউ আবার জোট না করেই আলাদা শক্তি দেখাতে চাইছে। আর ভোটাররা তাকিয়ে দেখছে—কে কার সঙ্গে যাচ্ছে, আর শেষ পর্যন্ত কোন সমীকরণে দাঁড়াবে আগামী জাতীয় নির্বাচনের লড়াই।

