১৯৯৫ সালে রাজধানী ঢাকার পাশেই ‘আধুনিক ও পরিকল্পিত নগরী’ গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়ে শুরু হয়েছিল পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্প। তিন দশক পেরিয়ে গেলেও শহরটি এখনও পূর্ণাঙ্গভাবে বসবাস উপযোগী হয়নি। প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হলেও পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাসসহ মৌলিক নাগরিক সুবিধা নেই। অবকাঠামোর ঘাটতি ও অসম্পূর্ণ সড়ক ব্যবস্থার কারণে জমির মালিকরা এখানে বসতি স্থাপন করতে গিয়ে প্রতিনিয়ত ভোগান্তিতে পড়ছেন।
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) এখন নতুন করে প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নিয়েছে পূর্বাচলকে সম্পূর্ণ বসবাসযোগ্য করার জন্য। উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হলেও বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, যদি বরাদ্দ নীতির সংস্কার না হয়, তাহলে প্রকল্পটি বসবাসের উপযোগী হওয়া ভারসাম্যহীন হয়ে থাকবে।
তিন দশক আগে নেওয়া পূর্বাচল প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য ছিল ঢাকার মধ্যবিত্তের আবাসন সংকট কমানো ও রাজধানীর জনচাপ হ্রাস করা। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে, সাড়ে তিন কোটি মানুষের শহর ঢাকা বিশ্বের দ্বিতীয় জনবহুল শহরের তকমা অর্জন করেছে, আর পূর্বাচলকে আবাসনের বদলে জমির বড় বাজার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. আকতার মাহমুদ বলেন, “দরিদ্র জনগণ থেকে অধিগ্রহণ করা জমি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে এমন ব্যক্তিদের, যাদের আসলে আবাসনের প্রয়োজন নেই। ফলে প্লটগুলো দীর্ঘদিন খালি পড়ে আছে। রাজউক তাদেরই বরাদ্দ দিয়েছে, যাদের বিকল্প আবাসন রয়েছে। সরকারের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা, রাজনীতিবিদরা তো গুলশান-বনানীর মতো অভিজাত এলাকায় বসবাস করছেন।”
ড. মাহমুদ আরও বলেন, “যাদের বিকল্প আবাসন আছে তাদের প্লট বরাদ্দ বাতিল করলে রাতারাতি পূর্বাচলে মানুষ বসবাস শুরু করতে পারত। কিন্তু রাজউক তা করছে না। বরং ৯ হাজার কোটি টাকার নতুন প্রকল্প নিয়ে আরও দুর্নীতি করার সুযোগ তৈরি করছে, যা সম্পূর্ণ জনগণের টাকার অপচয়।”
নতুন প্রকল্প ও ব্যয় বিবরণ
রাজউক গত আগস্টে ‘পূর্বাচল অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প’ শীর্ষক ডিপিপি পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছে। প্রস্তাবে প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে ৮ হাজার ৮৭০ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। এতে ভূমি উন্নয়ন, সড়ক সম্প্রসারণ, ফুটপাত, মসজিদ, মন্দির, মার্কেট, খেলার মাঠসহ মোট ১২টি খাত অন্তর্ভুক্ত। এর মধ্যে ভূমি উন্নয়নে ১৮৭ কোটি, ৩৩৭ কিলোমিটার সড়ক উন্নয়নে ১ হাজার ৫১১ কোটি, নতুন রাস্তা নির্মাণে ৩২৩ কোটি, ১০টি স্লুইচগেট ও একটি বক্স কালভার্ট নির্মাণে ১৬১ কোটি, ২০ হাজার বর্গমিটার আবাসিক ভবন নির্মাণে ১৪০ কোটি, ২৭৬টি মসজিদ ও তিনটি অন্যান্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নির্মাণে ৭৬৭ কোটি, স্ট্রিট লাইট স্থাপনে ৫৪৫ কোটি এবং ১৯টি কাঁচাবাজার নির্মাণে ১ হাজার ৩৪০ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে।
শিক্ষার ক্ষেত্রেও ব্যয় রাখা হয়েছে। পূর্বাচল স্কুল অ্যান্ড কলেজ নির্মাণে ২৮৮ কোটি টাকা ব্যয় করা হবে। ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হয়ে প্রকল্পটি ২০২৮ সালের জুনে শেষ হওয়ার কথা। চার হাজার শিক্ষার্থী এতে পড়াশোনা করতে পারবে এবং পূর্বাচলে বসবাসকারী ১৬ লাখ মানুষ সুবিধাভোগী হবে। তবে পরিকল্পনা কমিশন জানিয়েছে, স্কুলের ফিজিবিলিটি স্টাডিতে পুনঃমূল্যায়ন প্রয়োজন।
সমালোচনা ও নাগরিক সুবিধা সংকট
পরিকল্পনা কমিশনের অতিরিক্ত সচিব কবির আহামদ বলেন, “পূর্বাচলকে বাসযোগ্য করতে অবকাঠামো নির্মাণ প্রয়োজন। কিন্তু যেখানে মানুষ চলাচলে সমস্যায় পড়েন, নিরাপত্তা নেই, হাসপাতাল-স্কুল নেই, সেখানে কে যাবে?”
নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, “রাজউকের উচিত ছিল প্লট বিক্রি না করে ফ্ল্যাট বানিয়ে বিক্রি করা। এতে আবাসন সমস্যা সমাধান হতো। কিন্তু প্লট বরাদ্দ দিয়ে রাজউক ক্রেতাদের পরিশ্রম ছাড়া ধনী বানাচ্ছে। এটি আইনের শাসন ও ন্যায্যতার পরিপন্থী।”
জমির দামও বাধার অন্যতম। প্লটের হাতবদল হলে দাম কয়েক গুণ বেড়ে যায়। এমনকি সব নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত হলে ও ভবিষ্যতে আবাসন ব্যবস্থা কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় গড়ে ওঠার সম্ভাবনা কম, শুধুমাত্র জমির উচ্চমূল্যের কারণে।
রাজউক চেয়ারম্যান মো. রিয়াজুল ইসলাম বলেন, “নতুন প্রকল্পটি পূর্বাচল নতুন শহরের অবকাঠামো নির্মাণের জন্য নেওয়া হয়েছে। অসমাপ্ত কাজগুলো সম্পূর্ণ করা হবে এবং নতুন অবকাঠামো তৈরি করা হবে।”

