দেশের ব্যাংক খাত এখন ভয়াবহ খেলাপি ঋণের চাপে নাজুক অবস্থায়। লাগামহীন ঋণ বৃদ্ধিকে উদ্বেগজনক হিসেবে চিহ্নিত করেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। সংস্থাটি বলছে, যেসব ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার ৩০ শতাংশ ছাড়িয়েছে, সেগুলোকে একীভূত বা অবসায়নের আওতায় আনা দরকার।
সফররত আইএমএফ প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈঠকে এই পরামর্শ দেওয়া হয়। এরপর গত বুধবার ব্যাংক খাতের সংকট মোকাবিলায় দেশের ৪৭টি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ডেপুটি গভর্নর কবির আহমেদের সভাপতিত্বে বৈঠকে খেলাপি ঋণ কমাতে সর্বোচ্চ পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। বৈঠকে রাষ্ট্রায়ত্ত, বিশেষায়িত ও বেসরকারি ব্যাংকগুলোর প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। তবে একীভূতকরণ প্রক্রিয়াধীন পাঁচটি ব্যাংক এবং খেলাপি ঋণের হার কম থাকা বিদেশি ব্যাংকগুলো বৈঠকে রাখা হয়নি।
সূত্র জানায়, আইএমএফ বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে জানতে চায়, খেলাপি ঋণের প্রকৃত তথ্য প্রকাশে বিলম্ব কেন, ঋণ বাড়ার কারণ কী এবং তা কমাতে কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক কিছু উদ্যোগের কথা জানিয়েছে, তবে আইএমএফের একীভূতকরণ বা অবসায়নের পরামর্শে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া দেয়নি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের মার্চে ৩০ শতাংশের বেশি খেলাপি ঋণ রয়েছে এমন ব্যাংকের সংখ্যা ১৬টি। এর মধ্যে পাঁচটি ব্যাংক ইতোমধ্যে একীভূতকরণের প্রক্রিয়ায় রয়েছে। বৈঠকে উপস্থিত একাধিক এমডি জানিয়েছেন, সেপ্টেম্বর মাসে খেলাপি ঋণের হার প্রায় ৩১ শতাংশে পৌঁছেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানতে চায়, ব্যাংকগুলো কীভাবে ঋণ কমাবে এবং তারা কী ধরনের সহায়তা দেবে। নির্দেশনা অনুযায়ী, পুনঃতফসিল, আইনগত ব্যবস্থা বা অন্যান্য মাধ্যমে ডিসেম্বরের মধ্যেই খেলাপি ঋণ কমাতে হবে। প্রয়োজনে বাংলাদেশ ব্যাংক সহায়তা দেবে বলেও বৈঠকে জানানো হয়েছে।
আইএমএফের উদ্বেগের পেছনে সাম্প্রতিক কয়েক বছরের অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রভাব রয়েছে। ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ সরকারের সময় একাধিক ব্যাংকে ব্যাপক দুর্নীতি ও লুটপাট ঘটে। ক্ষমতাসীন প্রভাবশালী ব্যবসায়ীরা হাজার হাজার কোটি টাকা তুলে নিলেও ব্যাংকের প্রকৃত আর্থিক চিত্র গোপন রাখা হয়। কিন্তু সরকারের পরিবর্তনের পর প্রকৃত অবস্থা প্রকাশ্যে আসে। দেখা যায়, অনেক ব্যাংক খেলাপি ঋণে ডুবে আর্থিক সংকটে, এমনকি গ্রাহকের আমানত ফেরত দিতে হিমশিম খাচ্ছে।
এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকার ব্যাংক খাত সংস্কারের উদ্যোগ নেয়। ইতোমধ্যে দুর্বল পাঁচটি শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক একীভূত করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। পাশাপাশি খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল ও পুনর্গঠনের সুযোগ সম্প্রসারণ করা হয়েছে। গত ১৬ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংক মাত্র ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্টে ১০ বছরের জন্য ঋণ পুনঃতফসিলের সুযোগ দিয়েছে। সুবিধা পেতে ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে আবেদন করতে হবে। এর আগে ৩১ জানুয়ারি গঠিত নীতিসহায়তা কমিটির মাধ্যমে চার শতাধিক প্রতিষ্ঠান পুনঃতফসিল সুবিধা পেয়েছিল।
এছাড়া গত মাসে খেলাপি ঋণ অবলোপন নীতিমালায় শিথিলতা আনা হয়। নতুন নিয়ম অনুযায়ী, মাত্র ৩০ দিনের নোটিস দিয়ে ‘মন্দ’ মানের খেলাপি ঋণও অবলোপন করা যাবে। পূর্বে এটি সম্ভব ছিল শুধুমাত্র দুই বছরের পুরোনো ঋণের ক্ষেত্রে।

