টানা কয়েক বছরের মন্দার পর বাংলাদেশের হিমায়িত মাছ রপ্তানি খাত এবার শক্তিশালীভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। যদিও বঙ্গোপসাগর থেকে মাছ আহরণ ২১ শতাংশ কমেছে এবং চিংড়ি চাষে নানা ধরনের চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে, তবুও রপ্তানির দিক থেকে আশাব্যঞ্জক বৃদ্ধি দেখা গেছে।
রপ্তানি বৃদ্ধির প্রধান কারণ
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে হিমায়িত মাছ ও চিংড়ি রপ্তানি থেকে বাংলাদেশ আয় করেছে ৩৮৮.৭ মিলিয়ন ডলার। এটি আগের অর্থবছরের ৩২৫.৭৩ মিলিয়নের তুলনায় ১৯.৩৩ শতাংশ বেশি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উন্নত মান নিয়ন্ত্রণ, ট্রেসেবিলিটি ব্যবস্থা ও রোগ ব্যবস্থাপনার উন্নতি, আন্তর্জাতিক মানের প্রক্রিয়াজাতকরণ সুবিধা এবং টাকার পতন রপ্তানি প্রতিযোগিতা বাড়াতে বড় ভূমিকা রেখেছে।
বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএফইএ) জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি তারিকুল ইসলাম জহির জানান, “রপ্তানিকারকেরা নতুন কমপ্লায়েন্স শর্ত দ্রুত মানিয়ে নিয়েছেন। ফলে উৎপাদন কম থাকলেও রপ্তানি আয় বাড়ছে।”
তবে তিনি উল্লেখ করেন, চিংড়ি খামারগুলোতে উচ্চ উৎপাদন ব্যয়, লবণাক্ত পানি ব্যবহার নিয়ে পরিবেশবাদীদের আপত্তি, রোগব্যাধি, নদী-খালের পলি জমে যাওয়া এবং ঋণ সুবিধার সীমাবদ্ধতা এখনো বড় চ্যালেঞ্জ।
চিংড়ি: রপ্তানির প্রধান চালিকা শক্তি
ইপিবির তথ্যানুযায়ী, মাছ রপ্তানি আয়ের মূল অংশ এখনো চিংড়ির দখলে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশ ২৩,২৩৮ টন হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানি করে ২৯৬.২৯ মিলিয়ন ডলার আয় করেছে। এটি আগের বছরের তুলনায় মূল্যে ১৯.৩২ শতাংশ এবং পরিমাণে ২১.৫ শতাংশ বৃদ্ধি।
চিংড়ির প্রতি কিলোগ্রামের গড় রপ্তানি মূল্য সামান্য কমে ১২.৭৫ ডলারে নেমেছে। অন্যদিকে, হিমায়িত মাছের রপ্তানি মূল্য বেড়ে ১১.৬২ ডলারে উঠেছে। এর মানে, ক্রেতারা উচ্চমূল্যের মাছ বেছে নিচ্ছেন অথবা বৈশ্বিক মৎস্যবাজারে মূল্যস্ফীতি প্রভাব ফেলেছে।
বৈশ্বিক চাহিদা ও বাজার পরিবর্তন
চিংড়ি রপ্তানিতে চীন সবচেয়ে বড় বাজারে পরিণত হয়েছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে চীন বাংলাদেশ থেকে ৫৬.৬৯ মিলিয়ন ডলারের চিংড়ি আমদানি করেছে। নেদারল্যান্ডস ৪৭.৩৯ মিলিয়ন ডলার এবং যুক্তরাজ্য ৪৪.৯৬ মিলিয়ন ডলারের চিংড়ি আমদানি করেছে।
হিমায়িত মাছের ক্ষেত্রে ভারতের অবস্থান শীর্ষে। ভারত ৬২.৫৪ মিলিয়ন ডলারের মাছ আমদানি করেছে, তার পরে চীন ৫৯.০৩ মিলিয়ন ডলার এবং যুক্তরাজ্য ৫২.৮৭ মিলিয়ন ডলার।
চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে
মৎস্য রপ্তানি বাংলাদেশের উপকূলীয় অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা ও চট্টগ্রামের উপকূলীয় অঞ্চলের লক্ষাধিক মানুষ এই খাতে জীবিকা নির্বাহ করেন।
তবে উৎপাদন কম, পানিদূষণ, মানসম্মত ব্রুডস্টকের অভাব, রোগব্যাধি এবং দুর্বল জৈব-নিরাপত্তা ব্যবস্থা এখনো বড় চ্যালেঞ্জ। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে চাষযোগ্য এলাকা কমে আসায় অনেক খামারি মিক্সড অ্যাকুয়াকালচার পদ্ধতির দিকে ঝুঁকছেন। রপ্তানি বাজারে ইউরোপীয় ইউনিয়নের কঠোর মানদণ্ড ও অ্যান্টিবায়োটিক অবশিষ্ট যাচাইয়ের কারণে কমপ্লায়েন্স ব্যয়ও বাড়ছে।
চট্টগ্রামের রপ্তানিকারক দোদুল কুমার দত্ত জানান, “ট্রেসেবিলিটি ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত না হলে প্রিমিয়াম বাজার হারানোর ঝুঁকি রয়েছে। দেশে ১১০টি মৎস্য প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানার মধ্যে বর্তমানে সক্রিয় মাত্র ৩০–৪০টি, যার মধ্যে পূর্ণ সক্ষমতায় চলছে মাত্র ১০টি। খামার পর্যায়ে উৎপাদন বাড়লেই অচল কারখানাগুলো চালু করা সম্ভব।”
দীর্ঘ মন্দার পর বাংলাদেশ হিমায়িত মাছ ও চিংড়ি রপ্তানি খাতে নতুন আশা জাগিয়েছে। তবে এর সঙ্গে সঙ্গে খামার, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও পরিবেশবান্ধব চাষাবাদে বিনিয়োগ বাড়ানো না হলে এই বৃদ্ধির টেকসই সুফল পাওয়া যাবে না। রপ্তানির সঙ্গে উৎপাদন ও মান নিয়ন্ত্রণের সমন্বয়ই এখনো সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

