দেশ থেকে হঠাৎ বড় পরিমাণে ডলার বের হচ্ছে। নতুন অর্থবছরের শুরুতেই এই প্রবাহ বৈদেশিক বাণিজ্যে চাপ সৃষ্টি করেছে। রপ্তানি আয় বাড়লেও আমদানি ব্যয় আরও দ্রুত বেড়ে গেছে। ফলে বাণিজ্যের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে আবারও ঘাটতিতে পড়েছে দেশ।
বাণিজ্য বিশ্লেষক ও অর্থনীতিবিদদের মতে, রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় ইতিবাচক থাকলেও অপ্রয়োজনীয় ব্যয় ও ডলারের অতিরিক্ত বহির্মুখী প্রবাহ বাণিজ্য ঘাটতিকে আরও বাড়াচ্ছে। অর্থনীতির স্থিতিশীলতার জন্য এটি নতুন সতর্কবার্তা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই প্রবাহের পেছনে অর্থ পাচারের কোনো ছায়া আছে কি না তা খতিয়ে দেখা জরুরি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখা যায়, চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) বাণিজ্য ঘাটতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৭১ কোটি ডলারে। এটি আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১০৭ কোটি ডলার বেশি। রমজানকে সামনে রেখে বাড়তি আমদানি, বিদেশ ভ্রমণ ও চিকিৎসা ব্যয়ও যুক্ত হয়েছে। ফলে দীর্ঘ সময় পর চলতি হিসাবও ঋণাত্মক হয়েছে, ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৪৮ কোটি ডলারে। এই সময়ে দেশে মোট রপ্তানি আয় হয়েছে ১,১০৮ কোটি ৭০ লাখ ডলার। বিপরীতে আমদানি ব্যয় দাঁড়িয়েছে ১,৬৮০ কোটি ডলারে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের একই সময়ে বাণিজ্য ঘাটতি ছিল ৪৬৪ কোটি ডলার। অর্থাৎ এক বছরে ঘাটতি প্রায় ২৫ শতাংশ বেড়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর আমদানি ও রপ্তানিতে কিছুটা স্থিতি ফিরেছিল। কিন্তু বিদেশে চিকিৎসা, শিক্ষা ও ভ্রমণ ব্যয় বেড়ে আবারও ডলারের ওপর চাপ তৈরি হয়েছে। রমজানকে সামনে রেখে খাদ্য, তেল, চিনি ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি বাড়ায় পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার আয় বাড়লেও ব্যয়ের হার তার চেয়ে বেশি হওয়ায় চলতি হিসাব আবারও ঘাটতিতে পড়েছে। তবে সামগ্রিক লেনদেন ভারসাম্যে কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। আগের বছর জুলাই-সেপ্টেম্বরে যেখানে ঘাটতি ছিল ১৪৮ কোটি ডলার, চলতি অর্থবছরে তা ঘুরে দাঁড়িয়ে ৮৫ কোটি ডলার উদ্বৃত্ত হয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন মনে করেন, রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় বাড়লেও ডলারের অস্বাভাবিক বহির্মুখী প্রবাহ উদ্বেগজনক। তাঁর ভাষায়, ‘দেশ থেকে এত বেশি ডলার কোথায় যাচ্ছে, তা স্পষ্ট নয়। এর মধ্যে অর্থ পাচারের ছায়া রয়েছে। আমদানির কড়াকড়ি কিছুটা শিথিল করায় অনেকে সুযোগ নিচ্ছে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে প্রবাসীরা ৭.৫৯ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন, যা গত বছরের তুলনায় প্রায় ১৬ শতাংশ বেশি। পাশাপাশি প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ বেড়ে ৩১ কোটি ৮০ লাখ ডলারে দাঁড়িয়েছে, যা আগের বছরের তুলনায় প্রায় ৩ গুণ। তবে শেয়ারবাজারে বিদেশি বিনিয়োগ ঋণাত্মক; গত বছর নিট বিনিয়োগ ছিল ৫০ লাখ ডলার, এবার ঋণাত্মক ৪ কোটি ২০ লাখ ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বলেন, ‘ডলার-সংকট মোকাবিলায় আমরা কিছু নীতি শিথিল করেছি, যাতে আমদানিতে প্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহ নিশ্চিত থাকে। তবে এর ফলে ব্যয় বেড়ে গেছে, বিশেষ করে রমজানকেন্দ্রিক আমদানিতে। মূলত এ কারণেই বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েছে।’

