পুঁজিবাজারের মন্দাভাব যেন কাটছেই না। দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (DSE-Dhaka এর Stock Exchang) বর্তমানে এক অস্বাভাবিক ভাটায় ভাসছে। যেখানে লেনদেনের পরিমাণ ক্রমাগত কমে যাচ্ছে। বাজারের এই অস্থিরতা বিনিয়োগকারীদের জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সংকট কাটিয়ে উঠতে সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে, কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি প্রতিদিন নতুন চ্যালেঞ্জ নিয়ে আসছে। ২০২৩ সালের শেষের দিকে বিশ্ব অর্থনীতি মন্দার দিকে যাচ্ছিল, যা বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও প্রভাব ফেলেছে। এর ফলে দেশের শেয়ারবাজারে ব্যাপক দরপতন দেখা গেছে এবং বিনিয়োগকারীদের মধ্যে উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে।
বর্তমান পুঁজিবাজারের পরিস্থিতি:
বাংলাদেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ সম্প্রতি একাধিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ডিএসইতে সূচক বেশিরভাগ সময়ে স্থির থাকায় বাজারের অবস্থা স্থবির বলে মনে হয়েছে। সেপ্টেম্বর ২০২৪-এ সূচকটি সামান্য বৃদ্ধির মুখ দেখলেও এটি প্রায় ৬২৪৬ পয়েন্টের মধ্যেই ছিল। বাজারে স্থবিরতার প্রধান কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে ফ্লোর প্রাইস নির্ধারণ, যা শেয়ার বিক্রয়ের গতিতে প্রভাব ফেলছে এবং বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমিয়ে দিচ্ছে। গত সোমবারও (২৮ অক্টোবর) দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ৬৭ পয়েন্ট বা প্রায় দেড় শতাংশ কমেছে। তাতে ডিএসইএক্স সূচকটি আরও কমে নেমে এসেছে ৪ হাজার ৮৯৮ পয়েন্টে।
একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, আয়কর আইন ২০২৩ অনুযায়ী কোনো ব্যক্তি শ্রেণীর তালিকাভুক্ত কোম্পানি বা তহবিলের অর্জিত ৫০ লক্ষ টাকার অধিক মূলধনী আয়ের উপর কর প্রত্যাহার করা হয়। ফলে সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ কর প্রদানকারীদের জন্য সারচার্জসহ অর্জিত আয়ের উপর কর ক্ষেত্রবিশেষে প্রায় ৪০.৫ শতাংশ হয়। যা ব্যক্তির শ্রেণীর বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ বিমুখ করছে।এর ফলে পুঁজিবাজারের ওপর ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এর পাশাপাশি বৈদেশিক বিনিয়োগের হ্রাসও পুঁজিবাজারের পতনের একটি বড় কারণ।
এ অবস্থায় বিনিয়োগকারীরা কি ভাবছেন?
বাংলাদেশের বর্তমান পুঁজিবাজারের অস্থিরতার কারণে বিনিয়োগকারীরা ব্যাপক অনিশ্চয়তা এবং আস্থার সংকটে ভুগছেন। সাম্প্রতিক সময়ে ডিএসইএক্স সূচকের স্থবিরতা, ফ্লোর প্রাইসের নিয়ম, উচ্চ ব্যাংক সুদহার এবং অর্থনৈতিক চাপ তাদের দুশ্চিন্তায় ফেলছে। এই পরিস্থিতিতে বিভিন্ন শ্রেণির বিনিয়োগকারী ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে মূল্যায়ন করছেন।
ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী: এ শ্রেণির বিনিয়োগকারীরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। তাদের অনেকেই উচ্চ রিটার্নের আশায় পুঁজিবাজারে প্রবেশ করলেও বর্তমানে শেয়ার বিক্রি করতে না পারার কারণে ক্ষতির শিকার হচ্ছেন। ফ্লোর প্রাইসের কারণে শেয়ার কেনাবেচার সীমাবদ্ধতা তাদের বিনিয়োগকে আটকে রেখেছে, যা তাদেরকে আর্থিক সংকটে ফেলছে ।
প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী: ব্যাংক, বিমা কোম্পানি এবং মিউচুয়াল ফান্ডের মতো প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা বর্তমান পরিস্থিতি আরও সাবধানে পর্যবেক্ষণ করছেন। তারা বাজারের অস্থিরতার কারণে বড় ধরনের বিনিয়োগ থেকে বিরত রয়েছেন। কারণ ফ্লোর প্রাইসের কারণে তারা পোর্টফোলিওর মূল্যায়ন সঠিকভাবে করতে পারছেন না। এছাড়া ব্যাংকের উচ্চ সুদের হার ও ট্রেজারি বিলের রিটার্ন তাদের শেয়ার বাজারের বাইরে নিরাপদ বিনিয়োগের দিকে আকৃষ্ট করছে।
বিদেশি বিনিয়োগকারী: বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মধ্যেও আস্থার সংকট দেখা দিচ্ছে। টাকার মূল্য হ্রাস এবং অর্থনৈতিক অস্থিরতার কারণে তারা বাংলাদেশে তাদের বিনিয়োগ কমাতে শুরু করেছেন। বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়া এবং মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে যাওয়ার মতো কারণগুলো তাদের আস্থাকে আরও কমিয়ে দিয়েছে ।
স্বল্প-মেয়াদী বিনিয়োগকারী: যারা দ্রুত মুনাফার আশায় স্বল্প মেয়াদে বিনিয়োগ করেছিলেন, তারা এখন বাজারের স্থবিরতার কারণে লাভজনকভাবে বের হতে পারছেন না। ফল স্বরূপ, তাদের আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে।
অন্যদিকে, অনেক বিনিয়োগকারী নিরাপত্তার খোঁজে ব্যাংক ও সঞ্চয়পত্রের দিকে ঝুঁকছেন। যেখানে ফিক্সড ডিপোজিট বা ট্রেজারি বিল থেকে প্রায় ১১-১২% সুদ পাওয়া যাচ্ছে। এই পরিস্থিতি শেয়ার বাজারে নতুন অর্থের প্রবাহ কমিয়ে দিয়েছে। যার ফলে বাজারে বিনিয়োগকারীদের উপস্থিতি ও লেনদেনের পরিমাণ হ্রাস পাচ্ছে।
সরকারের পদক্ষেপ: বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। যেমন: বাজার স্থিতিশীল করার জন্য কিছু নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। বিএসইসি অল্প সময়ের মধ্যে একটি নতুন নীতিমালা প্রণয়ন করতে যাচ্ছে, যা বাজারের স্বচ্ছতা ও স্থিতিশীলতা বাড়াতে সহায়তা করবে। বিএসইসি সূত্রে জানা গেছে, শেয়ার বাইব্যাকের সুযোগ দেওয়া হয়েছে, যা কিছু কোম্পানির জন্য তাদের শেয়ার মূল্য বাড়াতে সহায়ক হতে পারে। সরকার বিনিয়োগকারীদের আস্থা পুনরুদ্ধার করতে একটি পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে, যা বাজারকে স্থিতিশীল করতে সহায়তা করবে।
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা: পুঁজিবাজারের বর্তমান অস্থিরতা কাটিয়ে উঠতে কিছু সময় লাগবে, তবে বিনিয়োগকারীদের জন্য নতুন সুযোগ রয়েছে। সঠিক সময়ে সঠিক শেয়ার কিনে তারা ভবিষ্যতে লাভবান হতে পারেন। বাজারের এই সংকট কেবল একটি চক্র, যা কিছু সময় পরে পরিবর্তিত হবে। আর্থিক বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দিচ্ছেন যে, বিনিয়োগকারীরা তাদের পোর্টফোলিও বৈচিত্র্যময় রাখেন এবং বাজারের পরিস্থিতি নিয়ে সচেতন থাকেন। এর ফলে তারা অস্থির সময়েও নিজেদের সুরক্ষিত রাখতে পারবেন।
বর্তমান পুঁজিবাজারের পরিস্থিতি বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে সচেতনতা ও সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমে তারা এই কঠিন সময় পার করতে সক্ষম হবেন। সরকারের পদক্ষেপ এবং বিনিয়োগকারীদের সঠিক মনোভাব পুঁজিবাজারের স্থিতিশীলতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিনিয়োগের মাধ্যমে একটি সুস্থ অর্থনীতির স্বপ্ন দেখতে হলে, সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন।