জাতীয় পুষ্টি চাহিদা পূরণ, গ্রামীণ দারিদ্র্য হ্রাস এবং কৃষকদের জীবনমান উন্নয়নে দেশি গবাদিপশুর উন্নত জাত তৈরির মাধ্যমে দুধ ও মাংস উৎপাদন বাড়াতে উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।
এই লক্ষ্য বাস্তবায়নে ২০২৫-২৬ অর্থবছর থেকে শুরু হচ্ছে পাঁচ বছর মেয়াদি একটি প্রকল্প—‘দুধ ও মাংস উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য প্রুভেন বুল উৎপাদন’। এ প্রকল্পের মাধ্যমে প্রজনন সক্ষম উন্নত জাতের ষাঁড় নির্বাচন ও বীর্য সংরক্ষণ করে দেশব্যাপী উন্নত প্রজাতির গরুর উৎপাদন বাড়ানো হবে।
৬৯ কোটি টাকার সরকারি অর্থায়নে প্রকল্পটি যৌথভাবে বাস্তবায়ন করবে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর (ডিএলএস) ও বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএলআরআই)। এটি দেশের চারটি বিভাগের ১৮টি জেলার ৯৩টি উপজেলায় পরিচালিত হবে।
প্রকল্পের আওতায় দেশি-ফ্রিজিয়ান, দেশি-সাহিওয়াল ক্রস, লাল চট্টগ্রাম, পাবনা, মুন্সীগঞ্জ ও উত্তরবঙ্গের ধূসর জাতের মোট ৪০০টি ষাঁড় বাছুর সংগ্রহ করা হবে। বাছুরগুলো তাদের মাতৃ গাভীর গড় দুধ উৎপাদনের ভিত্তিতে নির্বাচন করা হবে। এরপর কর্মক্ষমতা যাচাই করে ২০০টি ষাঁড়কে ‘বাছাইকৃত ষাঁড়’ হিসেবে নির্বাচন করা হবে। এদের বীর্য সংগ্রহের পর প্রজনন মান নিরূপণ করে সবচেয়ে উন্নত ষাঁড়গুলোকে ‘প্রুভেন বুল’ হিসেবে মনোনীত করা হবে।
প্রকল্প পরিচালক ড. এম মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এই প্রমাণিত ষাঁড়গুলো ব্যবহার করে উচ্চ ফলনশীল গবাদিপশুর জাত তৈরি সম্ভব হবে, যা দেশের দুধ ও মাংস উৎপাদনে বড় ভূমিকা রাখবে।
এই প্রকল্পের মূল লক্ষ্য হলো:
- গবাদিপশুর উৎপাদনশীলতা টেকসইভাবে বৃদ্ধি করা
- দেশীয় জাতের জিনগত বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণ ও উন্নয়ন
- মাঠ পর্যায়ে কৃষক ও কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সক্ষমতা বৃদ্ধি
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, এ উদ্যোগ দেশের খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনের লক্ষ্য পূরণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। তারা বলেন, ২০০৭ সালের জাতীয় প্রাণিসম্পদ উন্নয়ন নীতিতে প্রজনন পশু নির্বাচনের ক্ষেত্রে জেনেটিক মূল্যায়নের উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, যা এ প্রকল্পে প্রতিফলিত হচ্ছে।
প্রকল্প দলিল অনুযায়ী, বর্তমানে গ্রামে অনেক হাইব্রিড গাভী প্রতিদিন ২৫-৩০ লিটার দুধ দিচ্ছে। তবে এ উৎপাদন ধরে রাখতে হলে উন্নত বীর্য ব্যবহার জরুরি। অপরিকল্পিত প্রজনন এবং নির্বিচারে বীর্য প্রয়োগের ফলে গাভীর উৎপাদনশীলতা কমে যাচ্ছে। তাই টেকসই উৎপাদন নিশ্চিত করতে ‘প্রুভেন বুল’ ব্যবহারের বিকল্প নেই।
প্রকল্পের আওতায় ৩৪ হাজার ৩৭৫ জন কৃষককে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। এছাড়া ‘এলিট গরু’ কর্মসূচির অধীনে উচ্চ উৎপাদনক্ষম গাভীর ৭ হাজার ৫০০ মালিককে প্রণোদনা দেওয়া হবে। কৃষকদের উন্নত জাতের বীর্য ব্যবহারে উৎসাহিত করতে টিকা, ওষুধ এবং পশুখাদ্যও সরবরাহ করা হবে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) একজন মানুষের জন্য দৈনিক ২৫০ মিলিলিটার দুধ গ্রহণের পরামর্শ দেয়। কিন্তু বাংলাদেশে সে অনুপাতে দুধের গ্রহণ অনেক কম। ‘গৃহস্থালী আয় ও ব্যয় সমীক্ষা ২০২২’ অনুযায়ী, বর্তমানে মাথাপিছু গড় দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্যের দৈনিক গ্রহণ মাত্র ৩৪.১ গ্রাম। যা দেশে পশুপালন খাতে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা স্পষ্ট করে।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে গরু ও ছাগলের প্রায় দেড় লাখ খামার রয়েছে। এর মধ্যে নিবন্ধিত খামার ৬৬ হাজার এবং অনিবন্ধিত প্রায় ৭০ হাজার। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তালিকাভুক্ত খামারির সংখ্যা ৫ লাখ ৭৭ হাজার ৪১৬ জন। পুরো দুগ্ধশিল্পে সরাসরি ও পরোক্ষভাবে যুক্ত প্রায় ১ কোটি মানুষ। ফলে দেশজুড়ে গরু ও ছাগল উৎপাদনে এক ধরনের নীরব বিপ্লব ঘটছে।
প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের আশা, সরকারের নেওয়া প্রকল্পগুলো সফলভাবে বাস্তবায়িত হলে দেশের দুধ উৎপাদনে ঘাটতি অনেকটাই কমে আসবে এবং দুগ্ধশিল্পে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন সম্ভব হবে।

