গত বছর ৫ আগস্ট ছাত্র-শ্রমিক-জনতার বিশাল আন্দোলনের মধ্যদিয়ে সরকার পতনের পর এক বছর পেরিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর দেশের ব্যাংকিং খাত যে ধ্বংসের মুখ থেকে ফিরে এসেছে, তা সিপিডি আয়োজিত ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ৩৬৫ দিন’ শীর্ষক সেমিনারে স্পষ্ট করে বলেন। তিনি জানান, এই অগ্রগতি এসেছে সরকার গঠনের পর থেকে নেওয়া কার্যকর পদক্ষেপগুলোর ফলেই।
গভর্নর মনসুর বলেন, “গত বছরের আগস্টে যখন নতুন সরকার দায়িত্ব নিয়েছিল, তখন ব্যাংকিং খাত একেবারে ধ্বংসের কাষ্ঠে দাঁড়িয়ে ছিল। আমাদের সামনে দুইটি বড় চ্যালেঞ্জ ছিল — একটি ম্যাক্রোইকোনমিকে স্থিতিশীল করা এবং আর্থিক খাতের সংস্কার করা। যদিও এক বছরে পুরোপুরি সংস্কার সম্ভব নয়, তবে আমরা প্রত্যেক ক্ষেত্রে সংস্কারের কাজ শুরু করেছি।”
তদন্তমূলক ভাবেই দায়িত্ব নেওয়ার প্রথম দিকেই আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে আশ্বস্ত করেন তিনি। বলেন, “আমরা ঋণ সংযোগ রক্ষা করব এবং আমাদের সব পাওনা সময়মতো পরিশোধ করব। ফলে আমাদের অবস্থা শ্রীলঙ্কা বা পাকিস্তানের মতো কখনও হয়নি।”
অর্থনীতির অঙ্গনে ইতিবাচক পরিবর্তনের কথা তুলে ধরে গভর্নর জানান, রেমিট্যান্স প্রবাহ এবং রপ্তানি আয়ের জোরালো প্রবৃদ্ধি ঋণ পরিশোধে বড় সহায়ক ভূমিকা রেখেছে। আর মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করাও ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। গত বছরের ১৪ আগস্ট থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক এক ডলারও রিজার্ভ থেকে বিক্রি করেনি, বরং মার্কেট থেকে ডলার কিনেছে প্রতি ১২২ টাকায়। এই নিয়ন্ত্রণেই মুদ্রাস্ফীতি বর্তমানে ১০ শতাংশের নিচে এসে দাঁড়িয়েছে এবং ভবিষ্যতে তা ৫ শতাংশের নিচে নামার আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন গভর্নর।
তবে গভর্নর মনে করিয়ে দিয়েছেন, দেশের অর্থনীতি এখনও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে পিছিয়ে রয়েছে। নির্বাচনের আগে বড় ধরনের কোনো বিনিয়োগ আসবে না বলেও জানিয়ে দিয়েছেন, “আমরা ইতিমধ্যেই নির্বাচন-পরবর্তী সময়ের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি।”
ব্যাংকিং খাতের সংস্কারে সরকারি কমিশন না গঠনের কারণও ব্যাখ্যা করেন তিনি। বলেন, “কমিশন গঠনের ফলে সিদ্ধান্ত নিতে সময় লাগত ৬ থেকে ৯ মাস। তাই আমরা তিনটি টাস্কফোর্স গঠন করেছি—ব্যাংক খাত সংস্কার, বাংলাদেশ ব্যাংকের কার্যক্রম উন্নয়ন এবং বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ উদ্ধার।”
বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার কাজকে সবচেয়ে জটিল চ্যালেঞ্জ হিসেবে উল্লেখ করে গভর্নর জানান, এ কাজের জন্য অন্তত ৮ থেকে ১০টি মন্ত্রণালয়ের সমন্বয় প্রয়োজন। এরই মধ্যে ব্যাংক কোম্পানি আইন, মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ও বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার সংশোধন প্রক্রিয়া চলছে। এতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জবাবদিহিতা ও স্বাধীনতা বাড়ানো হবে।
আরও জানানো হয়, ডিপোজিট ইন্স্যুরেন্স আইন ও ঋণ আদালত আইনেও পরিবর্তন আনা হবে, যা দীর্ঘদিনের ঋণ খেলাপি মামলার দ্রুত নিষ্পত্তিতে সহায়তা করবে।
বিশেষভাবে বাংলাদেশ ব্যাংক রেজোলিউশন অর্ডিন্যান্স সংশোধনের মাধ্যমে ব্যাংক অনিয়মের কারণে তারল্য সংকটে পড়লে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরাসরি সেই ব্যাংক অধিগ্রহণ করতে পারবে। গভর্নর সতর্ক করে বলেন, “আর কোনো ছাড় নয়। কোনো ব্যাংক সঠিকভাবে পরিচালিত না হলে বাংলাদেশ ব্যাংক নিজ হাতে ব্যবস্থা নেবে।”
তাছাড়া, সব ব্যাংককে পর্যবেক্ষণের জন্য একটি ‘৩৬০ ডিগ্রি মনিটরিং’ সংস্থাও গঠন করা হবে, যা সমন্বিতভাবে ব্যাংক খাতের অনিয়ম প্রতিরোধ করবে।
অর্থনীতির ডিজিটাল রূপান্তরেও গুরুত্ব দিয়েছেন গভর্নর। তিনি জানান, নগদবিহীন অর্থ ব্যবস্থায় রূপান্তরের লক্ষ্যে কিউআর কোড ব্যবহার বাড়ানো, ক্রেডিট কার্ডের প্রসার, ক্ষুদ্র ঋণ সুবিধা, স্কুল পর্যায়ে ব্যাংকিং শিক্ষা এবং শিক্ষার্থীদের জন্য ২০০ টাকার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট চালু করা হয়েছে। এছাড়া আবাসন খাতেও সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। স্মার্টফোনের দাম কমিয়ে ডিজিটাল ব্যাংকিং বিস্তারেও মনোযোগ দেওয়া হচ্ছে।
গভর্নর আহসান এইচ মনসুরের বক্তব্য দেশের ব্যাংকিং খাতের বর্তমান অবস্থা ও ভবিষ্যত সম্ভাবনা সম্পর্কে স্বচ্ছ ও ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরে, যা দেশের অর্থনীতির জন্য আশার বার্তা বয়ে আনে।

