১৯৯০-এর দশকের শুরুতে চীনের অর্থনীতি ছিল জটিল ও নিয়ন্ত্রণহীন ব্যবস্থার ঘূর্ণাবর্তে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ঋণে জর্জরিত, বিনিয়োগ লাগামছাড়া ও খাপছাড়া, মূল্যস্ফীতি দুশ্চিন্তার চূড়ায় এবং ছায়া ব্যাংকিং ব্যবস্থা অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবে বিস্তৃত হচ্ছিল। এ পরিস্থিতিতে হাল ধরেন রক্ষণশীল কিন্তু বাস্তববাদী সংস্কারক জু রংজি। পশ্চিমা বিশ্বে যিনি ‘ইকোনমিক জার’ পরিচয়ে খ্যাত। চীনা রাজনীতির আলোচনায় সাধারণত মাও সেতুং, দেং শিয়াওপিং বা শি জিনপিংয়ের মতো ব্যক্তিত্ব প্রাধান্য পান, কিন্তু তাদের বাইরে প্রথম সারির যে নেতারা প্রায় বিস্মৃত হয়ে গেছেন, জু রংজি তাদেরই অন্যতম।
১৯৯১ সালে উপপ্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়ে চীনের অর্থনৈতিক সংস্কার শুরু করেন তৃণমূল থেকে। ওই সময় রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে পরস্পর ঋণ দিয়ে অর্থনৈতিক স্থবিরতা তৈরি হয়েছিল, যা ‘ত্রিভুজ ঋণ সংকট’ বা ‘ট্রায়াঙ্গেল ডেট ডিলেমা’ নামে পরিচিত। এ পরিস্থিতিতে একটি প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণ সরাসরি আরেক প্রতিষ্ঠানের খেলাপি হওয়ার কারণ হয়ে দাঁড়াত। আর সে প্রতিষ্ঠান আবার তৃতীয় প্রতিষ্ঠানের কাছে ঋণ শোধে ব্যর্থ হতো। ফলে একটি সংকটের প্রতিক্রিয়ায় পুরো অর্থনৈতিক ব্যবস্থা অচল হয়ে পড়ার উপক্রম হয়।
এ সংকটকে তীব্রতর করেছিল রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্বল ব্যবস্থাপনা ও ‘আয়রন বোল’ মানসিকতা। যেখানে কর্মচারী ও ব্যবস্থাপকরা মনে করতেন, ‘যা-ই হোক না কেন সরকার শেষ পর্যন্ত উদ্ধার করবে।’ এর ফলে প্রতিষ্ঠানগুলোর খেলাপি ঋণ, উৎপাদনশীলতার ঘাটতি ও দক্ষতার অভাব ভয়াবহ আকার নেয়। জু রংজি কঠোর সিদ্ধান্ত নিয়ে অকার্যকর ‘জম্বি’ প্রতিষ্ঠানগুলোকে দেউলিয়া হতে দেন। যার ফলে লাখ লাখ শ্রমিক ছাঁটাই হয় এবং ব্যাংক খাতে বিপুল অকার্যকর ঋণ সৃষ্টি হয়। কিন্তু এ পদক্ষেপই চীনকে সোভিয়েতধর্মী ব্যর্থ অর্থনৈতিক মডেল থেকে মুক্ত করে বাজারমুখী প্রতিযোগিতামূলক অর্থনীতির পথে নিয়ে যায়। খেলাপি ঋণ আদায়ে তিনি নিজে মাঠে নামেন। তিনটি প্রদেশে সশরীরে গিয়ে তিনি প্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থিক হিসাব তদারক করেন, দেনাদারদের তালিকা প্রস্তুত করান। প্রতিটি ঋণ নিষ্পত্তির জন্য সময়সীমা বেঁধে দেন। এ চেষ্টায় মাত্র ২৬ দিনে ১২ দশমিক ৫ বিলিয়ন ইউয়ান ঋণ পরিশোধ সম্ভব হয়।
জু রংজি ১৯৯৪ সালে একটি যুগান্তকারী কর সংস্কার চালু করেন, যা কেন্দ্রীয় সরকারের রাজস্ব উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করে। এ ব্যবস্থায় কর আহরণের মূল দায়িত্ব জাতীয় কর প্রশাসনের হাতে কেন্দ্রীভূত হয়। মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট), ভোক্তা কর ও শুল্ক আয় মূলত কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণে আসে। তার লক্ষ্য ছিল রাজস্ব সংগ্রহে শৃঙ্খলা আনা, আর্থিক ঘাটতি কমানো এবং কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে উন্নয়ন ও অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগের জন্য স্থিতিশীল অর্থের জোগান নিশ্চিত করা। এ সংস্কারের মাধ্যমে রাজস্ব আহরণ ২২ থেকে বেড়ে ৫৫ শতাংশেরও বেশি কেন্দ্রে আসতে শুরু করে।
রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প সংস্কারে জু রংজির অবস্থান ছিল অনমনীয়। তিনি ‘বেঁচে থাকো অথবা মরো’ নীতিতে বিশ্বাস করতেন। তার নীতি ছিল ‘রাষ্ট্র ব্যবসা চালাবে না, কর আদায় করবে; সফল হলে রাষ্ট্র উপকৃত হবে, ব্যর্থ হলে হস্তক্ষেপ করবে না।’ তিনি মনে করতেন শুধু বাজার খুলে দিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে না। বাজারে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোম্পানিকে টিকিয়ে রাখতে হলে সেগুলো পুনর্গঠন করতে হবে।
তিনি বলেছিলেন, ‘তোমাদের বাঁচার মতো যোগ্যতা থাকলে বাঁচো, না থাকলে তোমাদের বিলুপ্ত করা অনিবার্য।’ ওই সময় চীনের শত শত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ভর্তুকিতে চলছিল, এগুলো রাজনৈতিক অনুগ্রহের ওপর নির্ভরশীল ছিল। জু রংজি প্রথমে পরীক্ষা করে দেখেন কোন প্রতিষ্ঠান কাঠামোগতভাবে সংস্কারযোগ্য। তিনি ঘোষণা দেন, ‘সব প্রতিষ্ঠানকে বাঁচানো সম্ভব নয়। যারা কার্যকর তাদের সমর্থন করতে হবে। বাকিদের ছেড়ে দিতে হবে।’ এ নীতির অধীনে ছোট ও মাঝারি রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানকে ব্যক্তি বা সমবায় মালিকানায় হস্তান্তর করা হয়।
রংজির নীতি ছিল, ‘আজ থেকে রাষ্ট্র ও প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সেই পুরনো আশ্রয়-সন্তান সম্পর্ক আর থাকবে না। তুমি ব্যবসা করবে, আমি কর নেব।’ তিনি বড় প্রতিষ্ঠানকে শেয়ারবাজারে নিয়ে পাবলিক লিস্টিং করান। যাতে তারা সরকারি অনুদানের ওপর নির্ভরশীল না হয়ে বাজারমুখী হয়। তহবিল অনুদানকে প্রথমে বন্ডে রূপান্তর করেন, এরপর বন্ডকে শেয়ারে রূপান্তর করে শেয়ারবাজারে নিয়ে যান।
১৯৯৫ সালে কুইংদাও শহরের হায়ার কোম্পানি ঘোষণা দেয়, তারা ২০০৬ সালের মধ্যে বিশ্বের শীর্ষ ৫০০ কোম্পানির তালিকায় প্রবেশ করবে। এরপর একে একে প্রায় ৩০টি চীনা কোম্পানি একই লক্ষ্যের কথা জানায়। জু রংজি এ ঘোষণাগুলোকে কৌশলে ব্যবহার করে ছয়টি প্রতিষ্ঠানকে ‘জাতীয় টিম’ হিসেবে ঘোষণা দেন। এগুলো হলো বাওস্টিল, হায়ার, ছাংহং, ফাউন্ডার, নর্থ চায়না ফার্মাসিউটিক্যাল ও চিয়াংনান শিপইয়ার্ড। তিনি এসব কোম্পানিকে বিদেশী বিনিয়োগ ও প্রযুক্তি সহযোগিতার জন্য উন্মুক্ত করেন, আন্তর্জাতিক মানের করপোরেট গভর্ন্যান্স ও হিসাবপত্র প্রণালির ওপর জোর দেন।
একই সঙ্গে কৌশলগত খাতে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখে বাজারভিত্তিক প্রতিযোগিতা উৎসাহিত করেন। তাদের জন্য বরাদ্দ হয় বিশেষ ঋণ, প্রযুক্তিসহায়তা, প্রশাসনিক ছাড়—সব মিলিয়ে ‘জাতীয় করপোরেট চ্যাম্পিয়ন’ তৈরি করার পরিকল্পনা। বাওস্টিল ও হায়ার পরবর্তী সময়ে ফরচুন-৫০০ তালিকায় প্রবেশ করে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে চীনের মুখপাত্রে পরিণত হয়। রংজির সংস্কারের উত্তাপে ১৯৯৩ সালে চুক্তিবদ্ধ বিদেশী বিনিয়োগের অংক ছুঁয়ে ফেলে ১১১ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার, যা আগের বছরের প্রায় দ্বিগুণ।
প্রোক্টার অ্যান্ড গ্যাম্বল, আনহাইজার-বুশ, নকিয়া, বোয়িং, ওয়ার্লপুল, কোডাক—পশ্চিমের এ জায়ান্ট ব্র্যান্ডগুলো পা রাখল নতুন এক দুনিয়ায়। কোথাও গড়ে উঠল আকাশছোঁয়া কারখানা, কোথাও জোট বাঁধা হলো চীনা অংশীদারের সঙ্গে, আর চুক্তিপত্রে জমা হতে লাগল বিপুল অর্ডারের পাহাড়। এ বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার মধ্যে জেগে ওঠে দেশীয় শিল্পবোধ। লেনোভো ও ছাংহংয়ের ঘোষণাগুলো জাতীয় ব্র্যান্ড গঠনের প্রতীক হয়ে ওঠে।
নব্বইয়ের দশকে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই) খাতকে চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির অন্যতম চালিকাশক্তি হিসেবে দেখেছিলেন। রংজি বিশ্বাস করতেন, শুধু বৃহৎ রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পের ওপর নির্ভরশীল অর্থনীতি দীর্ঘমেয়াদে টেকসই নয়; বরং উদ্যমী ও উদ্ভাবনী ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা বাজারকে গতিশীল রাখবে। তার নেতৃত্বে ব্যাংকিং নীতিতে সংস্কার আনা হয়, যাতে এসএমই সহজ শর্তে ঋণ পেতে পারে। কর হ্রাস, প্রশাসনিক ফি কমানো এবং ব্যবসা নিবন্ধনের জটিলতা দূর করে নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য পথ প্রশস্ত করা হয়।
রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের একচেটিয়া আধিপত্য ভেঙে সরকারি ক্রয় ও অবকাঠামো প্রকল্পে ক্ষুদ্র কোম্পানির অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হয়। প্রযুক্তি হস্তান্তর, প্রশিক্ষণ কর্মসূচি ও উদ্ভাবনী কার্যক্রমে বিনিয়োগে উৎসাহ দেয়া হয়, যাতে এসএমই উৎপাদনশীলতা বাড়াতে পারে এবং আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতামূলক হতে পারে। এসব পদক্ষেপের কারণে জু রংজির নেতৃত্বে চীনের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাত অভূতপূর্ব উত্থান প্রত্যক্ষ করেছিল। এ সময়ে নিবন্ধিত এসএমইর সংখ্যা প্রায় তিন গুণ হয়, কর্মসংস্থান সাত কোটি থেকে বেড়ে ১১ কোটি ছাড়িয়ে যায়। শিল্প উৎপাদনে বার্ষিক গড় প্রবৃদ্ধি ১২-১৫ শতাংশে পৌঁছায়, যা বড় রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি। রফতানিতে এসএমইর অংশ ৪০ থেকে বেড়ে প্রায় ৬০ শতাংশে উন্নীত হয়।
প্রাচীনকাল থেকেই অর্থনীতির বিকাশ ও পরিকল্পিত-আধুনিক নগরায়ণের মধ্যে অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক দেখা যায়। জু রংজি চীনের শহরগুলোকে নতুন করে আঁকেন। শুধু রাস্তাঘাটে নয়, অর্থনৈতিক মানচিত্রেও। ধূসর কারখানার ধোঁয়া আর জরাজীর্ণ বন্দর এলাকা ধীরে ধীরে রূপ নিল আধুনিক ব্যবসা কেন্দ্রে। তিনি বুঝেছিলেন, বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে শহর হতে হবে বিনিয়োগবান্ধব, কর্মসংস্থানমুখী ও বাসযোগ্য। তাই পুরনো রাষ্ট্রায়ত্ত কারখানাগুলোর অবসান ঘটিয়ে জায়গা করে দিলেন উচ্চপ্রযুক্তি শিল্পাঞ্চল, রফতানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা ও আধুনিক বন্দর অবকাঠামোকে। পুডংকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রবেশদ্বার হিসেবে গড়ে তুললেন, যেখানে একসঙ্গে গড়ে ওঠে সুউচ্চ ভবন, ফ্রি-ট্রেড জোন আর বিশ্বমানের লজিস্টিক নেটওয়ার্ক।
বেইজিংয়ে তিনি অবকাঠামো উন্নয়ন করেন ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ তৈরির দিকে লক্ষ্য রেখে। পাশাপাশি তিয়ানজিন ও গুয়াংঝুর মতো শিল্প ও বন্দরনির্ভর শহরে বিনিয়োগ ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির নীতি প্রণয়নেও তার ভূমিকা ছিল। আধুনিক নগরায়ণের এ ঢেউ শুধু শিল্পে সীমাবদ্ধ থাকেনি; তিনি আবাসন খাতকে খুলে দেন বেসরকারি বিনিয়োগের জন্য, যার ফলে বহুতল আবাসিক কমপ্লেক্স দ্রুত মাথা তুলতে থাকে। সড়ক, সেতু, টানেল ও মেট্রোরেল নির্মাণে নজিরবিহীন গতি এনে সাংহাইকে আন্তর্জাতিক শহরে পরিণত করেন। পরিচ্ছন্নতা, ইউটিলিটি সেবা ও গণপরিবহন ব্যবস্থার মানোন্নয়ন ব্যবসায়িক আস্থাকে আরো দৃঢ় করে তোলে। এ নীতি পরে অন্যান্য শহরেও ছড়িয়ে যায় এবং এক দশকের মধ্যে চীনের নগরায়ণ এক অভূতপূর্ব গতি পায়।
চীনের জটিল আমলাতন্ত্রকে সংস্কারের মধ্যে আসতে বাধ্য করেছিলেন রংজি। অনেকের মতো তার প্রশাসনিক নীতি ছিল অদম্য—কখনো কখনো ভয়ংকর। কেউ কেউ তাকে বলতেন ‘অর্ধেকেরও কম জনপ্রিয়তাসম্পন্ন মানুষ’, কারণ তার কঠোরতা অনেককে অস্বস্তিতে ফেলত। কিন্তু বিশ্লেষকরা বলতেন, ‘চীন যদি সংস্কার করতে চায়, তবে তাকে এ ভয়ংকর ডাক্তারটির ওষুধ খেতে হবে।’ ১৯৯৭ সালের এশীয় আর্থিক সংকটে তিনি ইউয়ানের মান কমাননি। ব্যাংক অব চায়নার সংকট মোকাবেলায় তিনি নিজে নেতৃত্ব দিয়ে ব্যাংকিং, বীমা, স্টক মার্কেট নিয়ন্ত্রণে সংস্কার আনেন ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ক্ষমতা বাড়ান।
তিনি রাজনীতি ও অর্থনীতির সীমানা ঘোলাটে না করে স্পষ্ট রেখা টেনেছিলেন। তার সময়ে চীন প্রথম একটি দায়িত্বশীল, প্রতিযোগিতামূলক ও নিয়ন্ত্রিত বাজার অর্থনীতির রূপরেখা তৈরি করে। যেখান থেকে রক্ষণশীল একটি কমিউনিস্ট রাষ্ট্র ধীরে ধীরে রূপ নেয় বিশ্ববাজারের প্রতিযোগিতামূলক এক পরাশক্তিতে।
গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে পতন ঘটে শেখ হাসিনার ১৫ বছরের কর্তৃত্বপরায়ণ শাসনের। পতনের সময় বাংলাদেশের অর্থনীতি ছিল লুণ্ঠন, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের অদক্ষতা, অর্থ পাচার, বিপুল খেলাপি ঋণ, ব্যাংক খাতে নৈরাজ্য, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ডলার সংকট, বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে বড় ব্যর্থতা, ক্ষয়িষ্ণু রিজার্ভ, বসবাস অনুপযোগী নগর, ঘুস, দুর্নীতি, তীব্র বৈষম্য আর বিশৃঙ্খলা দিয়ে আক্রান্ত। শেখ হাসিনার আমলে মাফিয়া-সদৃশ ব্যবসায়িক ব্যবস্থা লুণ্ঠনের পথ খুলে দিয়েছিল। একচেটিয়া ও পোষ্য প্রকল্প এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানে নিয়মবহির্ভূত প্রবেশাধিকার লুণ্ঠন প্রক্রিয়াকে কাঠামোগত রূপ দেয়। অর্থনৈতিক মাফিয়ারা ব্যাংক ব্যবস্থাকে রুগ্ণ করে নিজেরা সম্পদ পাচার করেছে।
জুলাই অভ্যুত্থানের পর রাষ্ট্রের দায়িত্ব নেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। মানুষের মনে ছিল অদম্য প্রত্যাশা—নতুন সরকার অন্তত জরুরি শল্য চিকিৎসার মতো কাঠামোগত সংস্কার করে অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করবে, বিনিয়োগের শিরায় প্রাণ ফেরাবে, ব্যাংক খাতকে আবার দাঁড় করাবে, আমলাতন্ত্রের প্রাচীর ভাঙবে। কিন্তু জুলাই অভ্যুত্থানের এক বছরের মাথায় দেখা গেল বছরজুড়ে রাজনৈতিক সংস্কারের ডামাডোলে হারিয়ে গেছে রাষ্ট্রের অর্থনীতি ও প্রতিষ্ঠানকে টেকসই, ন্যায্যতাভিত্তিক ও দক্ষ করে গড়ে তোলার আলাপ। বাজারভিত্তিক, প্রতিযোগিতামূলক, ন্যায্যতানির্ভর, সুশৃঙ্খল অর্থনৈতিক কাঠামো তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার অগ্রাধিকার পায়নি।
দ্রুতগতির অর্থনৈতিক সংস্কার চীনকে কয়েক বছরের মধ্যে আধুনিক, প্রযুক্তিনির্ভর উৎপাদনমুখী অর্থনীতির যাত্রাপথে তুলে দিয়েছিল। চীন আজ শুধু অর্থনৈতিক সুপার পাওয়ারই নয়, তাদের অনেক নগরকে এখন প্রযুক্তিনির্ভর ভবিষ্যৎ দুনিয়ার উদাহরণ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। অথচ অভ্যুত্থানের এক বছর পর ঢাকা শহর এখনো বসবাস অনুপযোগীই রয়ে গেছে। অনেক ক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলা, অপরিচ্ছন্নতা, নিরাপত্তাহীনতা আরো বেড়েছে। এ শহর বিদেশী বিনিয়োগকারীকে তো পরের কথা, স্থানীয়দেরই ন্যূনতম স্বস্তি দিতে পারছে না।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার সময় দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির পরিস্থিতি ছিল বেশ নাজুক। গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী এক বছরে সামষ্টিক অর্থনীতির এসব সংকট অনেকটা কাটিয়ে উঠেছে বাংলাদেশ। এ সংকট কাটিয়ে ওঠার পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে ৫ আগস্টের পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে দুর্বৃত্তদের পালিয়ে যাওয়া। দেড় দশক ধরে যারা দেশের অর্থনীতিকে শোষণ করেছিল, তারা সরকার পতনের পর দেশ ছেড়ে পালায়। ফলে দুর্বৃত্তায়নের প্রবাহ থেমে গিয়ে এক ধরনের ‘প্রাকৃতিক নিরাময়’-এর মতো সামষ্টিক অর্থনীতির সংকট অনেকটা লাঘব হয়। কিন্তু অর্থনৈতিক সংস্কারের মাধ্যমে রাজনীতিনিরপেক্ষ অবস্থান থেকে রাষ্ট্র বিনির্মাণ প্রক্রিয়া এগোয়নি।
পতিত সরকারের আমলে দেশে সবচেয়ে বেশি লুটপাটের শিকার হয়েছে ব্যাংক খাত। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর কয়েকটি দুর্বল বেসরকারি ব্যাংক একীভূত করার ঘোষণা দেয়। বাংলাদেশ ব্যাংক এরই মধ্যে কিছু ব্যাংকের জন্য সম্ভাব্য অংশীদার চিহ্নিত করেছে এবং প্রাথমিক আলোচনা শুরু হয়েছে। এর মাধ্যমে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত করে মূলধন ঘাটতি ও সুশাসন সমস্যা সমাধানের চেষ্টা চলছে।
তবে বাংলাদেশে ব্যাংক পুনর্গঠনের তিনটি বড় ঘটনা হলো বিসিআইসি থেকে ইস্টার্ন ব্যাংক (ইবিএল), বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক ও বাংলাদেশ শিল্প ঋণ সংস্থার একীভূত হয়ে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড (বিডিবিএল) গঠন এবং ওরিয়েন্টাল ব্যাংক থেকে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক। এর মধ্যে একমাত্র সফল উদাহরণ ইবিএল, যা বেসরকারি খাতে দক্ষ ব্যবস্থাপনা ও আধুনিক ব্যাংকিং সেবা দিয়ে টিকে আছে।
বিপরীতে, বিডিবিএল এখনো লোকসান ও অদক্ষ ব্যবস্থাপনার সংকটে রয়েছে। আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক বিদেশী বিনিয়োগ সত্ত্বেও অনিয়ম ও দুর্বল কাঠামোর কারণে ঘুরে দাঁড়াতে ব্যর্থ হয়েছে। এ তিন ঘটনা বিশ্লেষণ স্পষ্ট করে যে কাঠামোগত সংস্কার, পেশাদার ব্যবস্থাপনা ও সুশাসন নিশ্চিত করলে ব্যর্থ ব্যাংকও ঘুরে দাঁড়াতে পারে—ইবিএল সেই করণীয়ের জলজ্যান্ত উদাহরণ।
বেসরকারি ব্যাংকের বিষয়ে উদ্যোগ নিলেও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো নিয়ে এখনো কোনো উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ দেখা যায়নি। পতিত সরকারের দেড় দশকে দেশের ব্যাংক খাত বিশেষ করে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক খাত অস্বচ্ছ ঋণপ্রক্রিয়া, দুর্নীতি ও লুণ্ঠনের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়। রাজনৈতিক প্রভাব, বিশেষ সুপারিশে বিপুল পরিমাণ ঋণ বিতরণ করা হয়, যার বড় অংশ খেলাপি হয়ে পড়ে। এ সময় ব্যাংকগুলো থেকে জমি বন্ধক রেখে ঋণ নেয়া ছিল সবচেয়ে প্রচলিত ও সহজ উপায়। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে বন্ধকি জমির দাম কাগজে কয়েক গুণ বাড়িয়ে দেখানো হয়েছে, যাতে অনুমোদিত ঋণের পরিমাণ বাড়ে। দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যাংক কর্মকর্তারা এসব কারসাজিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন।
ফলে বন্ধক রাখা সম্পত্তি বিক্রি করে ঋণ আদায় কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, খেলাপি ঋণের ক্ষেত্রে জামানত বিক্রি করে আদায়ের হার মাত্র ১২ দশমিক ৭৭ শতাংশ। গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে খেলাপি ঋণ শনাক্তকরণ শুরু হলেও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের মূল কাঠামোগত সংস্কার দেখা যায়নি। ব্যাংকগুলো এখনো ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে জামানতের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীল। যদিও জরুরি সংস্কারের একটি বড় দিক হওয়া উচিত ছিল জমি বা অন্য সম্পদ বন্ধক দেখানোর বদলে আবেদনকারীর আর্থিক ইতিহাস, ঋণ পরিশোধের রেকর্ড ও ক্যাশ ফ্লো বিশ্লেষণকে ঋণ অনুমোদনের মূল ভিত্তি করা।
এমনকি যেসব ব্যাংক ভালো অবস্থানে রয়েছে সেগুলোর আয়ের প্রধান উৎস হয়ে উঠেছে সরকারি কোষাগার। ব্যাংকগুলো এখন ব্যক্তি খাতকে না দিয়ে সরকারকেই বেশি ঋণ দিচ্ছে। এতে ফুলেফেঁপে উঠেছে বেশির ভাগ ব্যাংকের মুনাফা। অথচ আগে তাদের আয়ের বড় উৎস ছিল বেসরকারি খাত, তারা মুনাফা করত শিল্প ও সেবা খাতে দেয়া ঋণের সুদ ও কমিশন থেকে। কিন্তু এখন ব্যাংকের অর্জিত মুনাফার বড় অংশ আসছে সরকারি ট্রেজারি বিল-বন্ডে বিনিয়োগ থেকে। এ নির্ভরশীলতা কোনো ব্যাংকের জন্যই টেকসই বা স্বাস্থ্যকর নয়।
যেসব সংস্কার প্রক্রিয়া পরবর্তী রাজনৈতিক সরকারের জন্য উদাহরণ হয়ে থাকত, সে রকম কিছু এখনো অন্তর্বর্তী সরকার করতে পারেনি। দেশে গত ১৫ বছরে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্নীতি ও লুটপাটের সবচেয়ে বড় শিকার হলেও অন্তর্বর্তী সরকার সেগুলোকে শক্তিশালী বা সংস্কারের কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেয়নি। অদক্ষতা ও অপচয় আগের মতোই চলছে। এ অবস্থা পরিবর্তনে কোনো সংস্কার পরিকল্পনাও দেখা যায়নি অন্তর্বর্তী সরকারের গত এক বছরে। নব্বইয়ের দশকে চীন সরকারি খাত সংস্কারের ক্ষেত্রে অলাভজনক ও লোকসানি রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের পুনর্গঠন শুরু করেছিল। বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকারের সময় নীতিগত সংস্কারের সেই জায়গাটি এখনো শূন্য।
বিদ্যুৎ খাতের ক্রেতা, বিক্রেতা, বিতরণ ও উৎপাদনকারী রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি)। গত দেড় দশকে প্রতিষ্ঠানটি বিদ্যুৎ ক্রয় ও সক্ষমতা বাড়াতে গিয়ে বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর কাছে জিম্মি হয়েছে। এতে গত দেড় দশকে (২০১০-১১ অর্থবছর থেকে) সংস্থাটি বিপুল পরিমাণ লোকসানের বৃত্তে আটকে পড়েছে। বিদ্যুৎ ক্রয়-বিক্রয়ে অদক্ষতায় শুধু প্রতিষ্ঠানটি সরকারের কাছ থেকে গত দেড় দশকে ২ লাখ ৩৭ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি নিয়েছে, যার মধ্যে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ক্যাপাসিটি পেমেন্ট পরিশোধ হয়েছে ১ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা। বিদ্যুৎ খাতে দক্ষ ব্যবস্থাপনার অভাবে সংস্থাটি নিজস্ব আর্থিক সক্ষমতা হারিয়েছে। পাশাপাশি নিজস্ব সক্ষমতা বসিয়ে রেখে বিপুল জনবলের আর্থিক ব্যয় বহন করতে হচ্ছে।
দেশের জ্বালানি খাতে একসময়ের রাষ্ট্রীয় লাভজনক প্রতিষ্ঠান পেট্রোবাংলা। জ্বালানি উৎপাদন, আমদানি ও বিতরণ কার্যক্রম নিয়ে প্রতিষ্ঠানটি এখন হিমশিম খাচ্ছে। বিশেষ করে স্থানীয় গ্যাস অনুসন্ধান-উত্তোলনকে অবহেলা করে এলএনজি আমদানিতে গত আট বছরে ২ লাখ কোটি টাকা ব্যয় করেছে। অন্যদিকে ২০০৯ থেকে ২০২৪-এর জুন পর্যন্ত স্থানীয় গ্যাস অনুসন্ধানে বিনিয়োগ হয়েছে মাত্র ৮ হাজার কোটি টাকা। আমদানিনির্ভর জ্বালানিতে মনোযোগী হওয়ায় দেশের জ্বালানি নিরাপত্তায় যেমন ঝুঁকি বেড়েছে, সেই সঙ্গে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে পেট্রোবাংলা লাভজনক প্রতিষ্ঠান থেকে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ওপর ঋণনির্ভর হয়ে পড়েছে।
সরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন (বিসিআইসি) গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটির উৎপাদিত প্রধান পণ্য সার, যা দেশের কৃষি খাতকে শক্তিশালী রাখতে আবশ্যিক। কিন্তু গ্যাস সংকটজনিত কারণে অধিকাংশ সার কারখানা বছরের বেশির ভাগ সময় বন্ধ থাকে। যে কারণে সারের চাহিদা মেটাতে কারখানা থাকা সত্ত্বেও বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয়ে সার আমদানি হচ্ছে দেশে। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৯৬-৯৭ থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছর পর্যন্ত বিসিআইসি ৭ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা লোকসান করেছে। ২৮ বছরের মধ্যে ২৪ বছরই প্রতিষ্ঠানটি লোকসান করেছে। ১৯৭৬ সালে বিসিআইসির সূচনালগ্নে প্রতিষ্ঠানটির কারখানা ছিল ৮৮টি। এখন তা কমে ১৮টিতে নেমেছে। অথচ দক্ষ ব্যবস্থাপনা, স্বচ্ছতা ও টেকসই সংস্কার করা গেলে বিসিআইসির আওতাধীন দেশের সার কারখানাগুলো কৃষি খাতে সহায়ক বড় প্রতিষ্ঠান হিসেবে আবির্ভূত হতো।
দেশে কর্মসংস্থান ও বিনিয়োগের প্রধান উৎস বেসরকারি খাত। ১৯৯০ সালে সামরিক সরকারের পতনের পরে দেশ বাজার অর্থনীতির দিকে যাত্রা করে। এর পরে অর্থনীতি যতটা বড় হয়েছে তার প্রধান ভিত্তিও বেসরকারি খাত। যদিও অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর বেসরকারি খাতের সঙ্গে একটা চরম দূরত্ব তৈরি হয়েছে এমন অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের। তারা যে অনুপ্রেরণাহীনতায় ভুগছেন তা বোঝা যায় ক্যাপিটাল মেশিনারিজ আমদানি থেকে। এক বছর ধরে শিল্প উৎপাদন খাতের মৌলিক তিনটি উপকরণের (মূলধনি যন্ত্রপাতি, মধ্যবর্তী পণ্য ও কাঁচামাল) আমদানি এলসি খোলার প্রবণতা নিম্নমুখী।
কমিউনিস্ট দেশ হয়েও নব্বইয়ের দশকে যখন চীন দ্রুত বাজার অর্থনীতি দিকে ধাবিত হয়, তখন রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি খাতের কোম্পানিগুলোকে ফরচুন-৫০০-তে অন্তর্ভুক্ত করার ব্যাপক উদ্যোগ নেয়। বাংলাদেশের বেসরকারি খাতে অনেকের বিরুদ্ধে দুর্নীতি-লুটপাট ও মাফিয়া চরিত্রের অভিযোগ থাকলেও অনেক বড় উদ্যোগ আছে, যেগুলো অনুপ্রেরণা পেলে ফরচুন-৫০০-এ অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। এ লক্ষ্যে যাত্রা শুরু করতে পরবর্তী সরকারের জন্য অনুপ্রেরণামূলক কিছুই রেখে যাচ্ছে না ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার। যদিও ফরচুন-৫০০-এ অন্তর্ভুক্ত অনেক কোম্পানির সঙ্গে ড. ইউনূসের ঘনিষ্ঠতা ও ব্যক্তিগত যোগাযোগ রয়েছে। এসব কোম্পানি তার কাছ থেকে অনেক অনুপ্রেরণামূলক বক্তব্য ও পরামর্শও নিয়ে থাকে।
উন্নত বিশ্বে পুঁজির প্রধান জোগান দেয় শেয়ারবাজার। যদিও বাংলাদেশের পুঁজিবাজার স্বাধীনতার পর থেকেই অবহেলিত, অসাধু চক্রের কারসাজির স্থানে পরিণত হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর কিছু ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলেও কাঠামোগত কোনো সংস্কার করেনি। এক বছরে কোনো আইপিও আসেনি। যদিও দেশের পুঁজিবাজার শক্তিশালী না হলে ব্যাংক ঋণ অথবা বিদেশী বিনিয়োগের টাকায় উন্নত অর্থনীতি সম্ভব নয়।
জুলাই আন্দোলনের গণ-আকাঙ্ক্ষা ছিল জনমুখী, স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক ও দক্ষ জনপ্রশাসন গড়ে তোলা। তবে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পরও নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ড সেই প্রত্যাশাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। জনপ্রশাসন সংস্কারের অভিপ্রায়ে সংস্কার কমিশন যে প্রস্তাবগুলো সরকারকে দিয়েছিল, সেগুলোর দৃশ্যমান বাস্তবায়ন শুরু হয়নি। সরকারি চাকরিতে নিয়োগ বা পদোন্নতির প্রক্রিয়া চলছে পুরনো নিয়মে।
এছাড়া নির্বাচনের সম্ভাব্য সময়সূচি ঘোষণা হলেও তার প্রভাব পড়েনি মাঠ প্রশাসনে। ফলে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে শঙ্কা এখনো রয়েই গেছে। নতুন সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর জনসাধারণের সেবার মানেও আসেনি কোনো গুণগত পরিবর্তন। এছাড়া বিগত সরকারের পথ অনুসরণ করে এখনো ঢালাওভাবে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ অব্যাহত আছে। জনপ্রশাসনে অ্যাডমিন ক্যাডারদের প্রাধান্য দিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করছে সরকার, যা বিভিন্ন মহলে প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। শেখ হাসিনার সরকারের স্বৈরাচার হওয়ার পেছনে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা পালন করেছেন অ্যাডমিন ক্যাডাররাই। পাশাপাশি আওয়ামী লীগের আমলে অনুগত আমলাদের পুরস্কারস্বরূপ যে সিনিয়র সচিব পদ তৈরি হয়েছিল, অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেও সে পদে পদায়ন অব্যাহত রয়েছে।
গ্রামীণ অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ (এমএসএমই)। চীনসহ উন্নত বিশ্বের অনেক দেশ এসএমই খাতকে গুরুত্ব দিয়ে অর্থনীতির ভিত শক্তিশালী করেছে। কিন্তু বাংলাদেশে এ খাত সবসময়ই অবহেলিত। যদিও অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে অন্যতম চালিকাশক্তি হতে পারে এমএসএমই খাতের বিকাশ। এসএমই খাত জিডিপিতে ২৫-৩০ শতাংশ অবদান রেখে দেশের কর্মসংস্থান ও শিল্পায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। কিন্তু এ খাতের রয়েছে নানা চ্যালেঞ্জ, যেমন প্রযুক্তি ও মূলধনের অভাব, বাজার সম্প্রসারণের সীমাবদ্ধতা এবং অবকাঠামোগত দুর্বলতা। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর এ খাতে প্রাণসঞ্চারে উল্লেখযোগ্য কোনো পদক্ষেপ বা ভূমিকা গ্রহণ করতে দেখা যায়নি।
উন্নত অর্থনীতি এবং বাসোপযোগী আধুনিক, প্রযুক্তিনির্ভর, সুশৃঙ্খল শহর পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শহরগুলোর অর্থনীতির আকর্ষণীয়তার একটি সার্বিক চিত্র উপস্থাপন করে যুক্তরাজ্যভিত্তিক স্বাধীন অর্থনৈতিক পরামর্শদাতা সংস্থা অক্সফোর্ড ইকোনমিকসের তৈরি গ্লোবাল সিটিজ ইনডেক্স। এ ইনডেক্সের ২০২৫ সংস্করণে বিশ্বের ১৬০টিরও বেশি দেশের এক হাজার শহর অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। যেখানে অর্থনীতি, মানবসম্পদ, জীবনমান, পরিবেশ ও শাসন ব্যবস্থা—এ পাঁচ সূচকে একটি শহরের মূল্যায়ন করা হয়েছে।
এক্ষেত্রে অর্থনীতিতে ঢাকার র্যাংকিং ১০০০, শহরের মধ্যে ৩০৬। মানবসম্পদে ১৭৪, জীবনমানে ৭০২, পরিবেশে ঢাকার স্থান ৯১৪ ও শাসন ব্যবস্থায় ৮৭৩। ইনডেক্সটিতে ঢাকাসহ অন্তর্ভুক্ত থাকা বাংলাদেশের অন্য শহরগুলো হলো রাজশাহী, চট্টগ্রাম, খুলনা, সিলেট, ময়মনসিংহ, কুমিল্লা ও বগুড়া। তবে শুধু ঢাকা শহরকে ‘ডেভেলপিং মেগাসিটিজ’ ক্যাটাগরিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। যদিও অন্য শহরগুলোর কোনোটি আন্তর্জাতিক শহর হিসেবে বিদেশীদের কাছে পরিচিত নয়। ফলে বিদেশী বিনিয়োগ ও পর্যটন আকর্ষণের জন্য ঢাকাসহ কোনো নগর কেন্দ্র প্রস্তুত নয়। অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছরের শাসনামলে কোনো শহরেরই জীবনমান, পরিবেশ ও শাসন ব্যবস্থায় পরিবর্তনের যাত্রা শুরু করতে পারেনি, যা পরবর্তী সরকারের অনুকরণীয় হতে পারে।
জু রংজি দেখিয়েছিলেন, অর্থনৈতিক ভাগ্য পুনর্লিখন কেবল কাগুজে প্রতিশ্রুতি নয়; এটি সাহস, নেতৃত্ব ও অবিচল সংকল্পের পথযাত্রা। তিনি ধীরগতির কাঠামো ভেঙে নতুনের বীজ রোপণ করেছিলেন, লৌহহস্তে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনেছিলেন। এমন সংস্কার এনেছিলেন যা পরবর্তী প্রজন্মের জন্য সমৃদ্ধির আকাশ খুলে দিয়েছিল। তিনি বলেছিলেন, ‘আমার সামনে যদি মৃত্যুকূপ কিংবা অতল গহ্বরও থাকে, আমি বিন্দুমাত্র পেছনে না তাকিয়ে সোজা সামনে এগিয়ে যাব।’ আমূল পরিবর্তন আনতে এমন ইস্পাতকঠিন মনোভাব আবশ্যকীয়। যারা তা করতে পারেন পটপরিবর্তনের পাতায় তাদের নাম খোদাই হয়ে থাকে চিরকাল। সুত্র:দেওয়ান হানিফ মাহমুদ- সম্পাদক, বণিক বার্তা

