বাংলাদেশের রেমিট্যান্স আহরণে আবার শীর্ষে ফিরে এসেছে সৌদি আরব। গত কয়েক বছর শীর্ষস্থানে থাকা যুক্তরাষ্ট্র নামের তালিকায় নেমে গেছে পঞ্চম স্থানে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত তিন মাস ধরে যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ কমেছে। বিপরীতে সৌদি আরব, মালয়েশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশ থেকে রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েছে।
সম্প্রতি সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, দেশে রেমিট্যান্সের উৎস দেশের তথ্যের ভুল ছিল। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের মালিকানাধীন রেমিট্যান্স হাউজগুলো থেকে আসা অর্থ সেই দেশের হিসাবে ধরা হতো। চলতি বছরের এপ্রিল থেকে এই রিপোর্টিং পদ্ধতিতে সংশোধন আনা হয়েছে। ফলে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসা রেমিট্যান্স অর্ধেকে নেমে গেছে, আর সৌদি আরব থেকে আসা রেমিট্যান্স দ্বিগুণ হয়েছে।
এর আগে ৭ ফেব্রুয়ারি একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসা রেমিট্যান্সের বড় অংশ আসলে মধ্যপ্রাচ্য, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ইউরোপ ও লাতিন আমেরিকার দেশগুলো থেকে আসে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের মালিকানাধীন গেটওয়েগুলো এসব অর্থ প্রথম যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে আসে, এরপর বাংলাদেশে পাঠায়। এ কারণে দেশের ব্যাংকগুলো এসব রেমিট্যান্স যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসা বলে দেখায়। মূলত মাস্টারকার্ড, ওয়েস্টার্ন ইউনিয়নসহ মার্কিন মানি এক্সচেঞ্জ ও অ্যাগ্রিগেটরদের এই কার্যক্রমের ফলে পরিসংখ্যানে বড় গড়বড় সৃষ্টি হয়।
এই প্রতিবেদন প্রকাশের পর বাংলাদেশ ব্যাংক দ্রুত সংশোধনের উদ্যোগ নেয়। বাংলাদেশ নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বলেন, “মাস্টারকার্ড, ওয়েস্টার্ন ইউনিয়নসহ যুক্তরাষ্ট্রের রেমিট্যান্স হাউজগুলো মধ্যপ্রাচ্যসহ অন্যান্য দেশ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে যেত। এরপর যুক্তরাষ্ট্রের গেটওয়ে ব্যবহার করে বাংলাদেশে পাঠাত। এ কারণে মধ্যপ্রাচ্যের রেমিট্যান্সও যুক্তরাষ্ট্রের হিসাবে ধরা হতো। সম্প্রতি আমরা রিপোর্টিং পদ্ধতিতে সংশোধন এনেছি, তাই যুক্তরাষ্ট্রের নাম তালিকার নিচে নেমে যাচ্ছে।”
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর রেমিট্যান্স হাউজগুলোর সঙ্গে বৈঠক করে রিপোর্টিংয়ে স্বচ্ছতা আনার নির্দেশ দিয়েছেন। আরিফ হোসেন খান জানান, “বাংলাদেশ ব্যাংক এ বিষয়ে তদারকি করছে। ভবিষ্যতে উৎস দেশের তথ্য আরও স্বচ্ছ হবে। তখন হয়তো যুক্তরাষ্ট্র শীর্ষ দশের মধ্যেও থাকবে না।”
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, মার্চে যুক্তরাষ্ট্র থেকে রেমিট্যান্স এসেছে ৫৪ কোটি ৬১ লাখ ডলার। এরপর এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত তা কমে ৩৩ কোটি ৮ লাখ, ২২ কোটি ৩৭ লাখ ও ২৩ কোটি ৮১ লাখ ডলারে নেমে এসেছে। একই সময়ে সৌদি আরব, মালয়েশিয়া ও অন্যান্য দেশ থেকে রেমিট্যান্স বেড়েছে।
২০২৪-২৫ অর্থবছরের শেষ প্রান্তিকে (এপ্রিল থেকে জুন) সৌদি আরব থেকে এসেছে ১৪৯ কোটি ৩৮ লাখ ডলার। সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে এসেছে ১০৪ কোটি ৭৯ লাখ ডলার। যুক্তরাজ্য থেকে ১০০ কোটি ৩১ লাখ এবং মালয়েশিয়া থেকে ৯১ কোটি ডলার এসেছে। গত কয়েক বছর শীর্ষস্থানে থাকা যুক্তরাষ্ট্র থেকে রেমিট্যান্স এসেছে মাত্র ৭৯ কোটি ২৭ লাখ ডলার।
ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, যদি রিপোর্টিংয়ে সম্পূর্ণ স্বচ্ছতা নিশ্চিত হয়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে আসা রেমিট্যান্স আরও কমে যেতে পারে। কারণ এই তিন দেশের রেমিট্যান্স হাউজগুলো বিশ্বের অন্য দেশে বসবাসরত বাংলাদেশীদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে বাংলাদেশে বিক্রি করছে। আর ব্যাংকগুলো সেই অর্থ সেই দেশের রেমিট্যান্স হিসেবে দেখাচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্র থেকে বেশি রেমিট্যান্স দেখানোর পিছনে মাস্টারকার্ডের ভূমিকা সবচেয়ে বড়। ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ড নেটওয়ার্কের জন্য বিখ্যাত এ মার্কিন প্রতিষ্ঠানটি ২০১৯ সালে মানি এক্সচেঞ্জ কোম্পানি ট্রান্সফার্স্ট অধিগ্রহণের মাধ্যমে বৈশ্বিক রেমিট্যান্স বাজারে প্রবেশ করে। বর্তমানে মাস্টারকার্ড ২১০টিরও বেশি দেশে কাজ করছে। বাংলাদেশেও এটি রেমিট্যান্সের বড় মাধ্যম হয়ে উঠেছে। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসা রেমিট্যান্সের পরিসংখ্যান উল্লম্ফিত হয়েছে।
বাংলাদেশে মাস্টারকার্ডের কান্ট্রি ম্যানেজার সৈয়দ মোহাম্মদ কামাল বলেন, “রেমিট্যান্সের পরিসংখ্যানে বিভ্রান্তি ব্যাংকের দিক থেকে ছিল, মাস্টারকার্ড থেকে নয়। কিছু ব্যাংক মাস্টারকার্ড থেকে কেনা রেমিট্যান্স যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসা হিসাবে দেখিয়েছে। যদিও ওই অর্থ ১৬০-১৭০টি দেশ থেকে এসেছে। আমরা বাংলাদেশ ব্যাংককে বলেছিলাম, ব্যাংকগুলোকে রিপোর্টিংয়ে স্বচ্ছতা আনার নির্দেশনা দিতে।”

