দারিদ্র্য ও বৈষম্য থেকে ভঙ্গুর অর্থনীতি পুনরুদ্ধার করা আগামী নির্বাচিত সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। সাম্প্রতিক আমদানি বৃদ্ধির তথ্য দেখাচ্ছে, অর্থনীতি ধীরে ধীরে আবার গতি ফিরে পাচ্ছে। মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা অপরিহার্য।
কিছুটা নিয়ন্ত্রণ থাকলেও, মুদ্রাস্ফীতি এখনও ৮ শতাংশের উপরে। এর ফলে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমছে। মূল কারণ, পণ্যমূল্য দ্রুত বেড়েছে কিন্তু মজুরি তুলনামূলকভাবে কম বৃদ্ধি পেয়েছে। পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ (পিআরআই)-এর ‘মাসিক ম্যাক্রোইকোনমিক ইনসাইটস’ প্রতিবেদনে এসব তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর বনানীতে পিআরআই-এর কার্যালয়ে আগস্ট-সেপ্টেম্বর সংস্করণের প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।
প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য (সচিব) ড. মনজুর হোসেন। পিআরআই-এর প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. আশিকুর রহমান মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করেন পিআরআই চেয়ারম্যান ড. জাইদী সাত্তার। আলোচক হিসেবে ছিলেন পিআরআই-এর গবেষণা পরিচালক ড. বজলুল হক খোন্দকার, পলিসি এক্সচেঞ্জ অব বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ও সিইও ড. এম. মাসরুর রিয়াজ এবং মেঘনা গ্রুপের পরিচালক মিসেস তানজিমা মোস্তফা।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, অতীতে ব্যাংকগুলোকে লাভজনক দেখানোর জন্য উইন্ডো ড্রেসিং পদ্ধতি ব্যবহার হতো। এবার ১৭ মাস পর আমানতের প্রবৃদ্ধি দ্বিগুণ অঙ্কে পৌঁছেছে। টানা পাঁচ বছর এই প্রবণতা বজায় থাকলে অনাদায়ী ঋণ (এনপিএল) থেকে ক্ষতি পূরণ সম্ভব হতে পারে। তবে বাংলাদেশের কর-জিডিপি অনুপাত এখনও আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক মানের অনেক নিচে।
ড. মনজুর হোসেন বলেন, বিনিয়োগ বৃদ্ধি সামগ্রিক অর্থনৈতিক বাস্তুতন্ত্রের ওপর নির্ভরশীল। এটি রাতারাতি পুনরুজ্জীবিত করা সম্ভব নয়। বিনিয়োগ বাড়াতে মুদ্রানীতি কিছুটা শিথিল করা উচিত। যদিও সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কঠোর নীতি বজায় রাখায় হস্তক্ষেপ করছে না, এ অবস্থান কতদিন টিকিয়ে রাখা সম্ভব তা গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের মতো দেশগুলোকে আর্থিক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সমন্বয় বাড়াতে হবে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা অপরিহার্য।
ড. জাইদী সাত্তার বলেন, অতীতে শ্রম-নিবিড় পোশাক এবং অন্যান্য পণ্যে মার্কিন-বাংলাদেশ বাণিজ্য চালিত হতো তুলনামূলক সুবিধার ভিত্তিতে। নতুন পারস্পরিক শুল্ক ব্যবস্থায় এই নীতি বদলেছে। এখন আপেক্ষিক তুলনামূলক সুবিধার বদলে আপেক্ষিক শুল্ক সুবিধা প্রাধান্য পাচ্ছে। ড. আশিকুর রহমান বলেন, অর্থনৈতিক অভিজাতরা স্থায়ীভাবে কোনো রাজনৈতিক দলের অন্তর্ভুক্ত হন না। তবুও তারা রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রবেশে দক্ষ। তারা ধীরে ধীরে নীতি ও ক্ষমতার বলয় দখল করতে পারেন। তাদের প্রভাব বাড়লে অর্থনীতি ও সমাজে বিকৃতি ও অস্থিরতা দেখা দেয়। নিয়ন্ত্রণ না করলে তারা সুবিধা নেওয়া মানুষেরও ক্ষতি করে।
ইতিহাস দেখিয়েছে, উপমহাদেশের প্রভাবশালী দলগুলোর ক্ষেত্রে এটি ঘটেছে। নতুন রাজনৈতিক দল যারা সুশাসন ও সমাজকল্যাণে বিশ্বাসী, তাদের অবশ্যই আর্থিক খাতকে এই প্রভাব থেকে মুক্ত রাখতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা তাই জরুরি। এটি ভবিষ্যতে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও আর্থিক সম্পদ রক্ষার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এবং পরবর্তী নির্বাচিত সরকার এ বিষয়টি নির্ধারণ করবে।
ড. বজলুল হক খোন্দকার বলেন, দারিদ্র্য ও বৈষম্য কমাতে শুধুমাত্র প্রবৃদ্ধি যথেষ্ট নয়। বাংলাদেশে কর-জিডিপি অনুপাত মাত্র ৬.৬ শতাংশ, যা সমকক্ষ দেশগুলোর তুলনায় অনেক কম। সামাজিক সুরক্ষা বরাদ্দের মাত্র ১ শতাংশই সরাসরি দরিদ্রদের কাছে পৌঁছায়।
ড. এম. মাসরুর রিয়াজ বলেন, নতুন বিনিয়োগ ছাড়া কর্মসংস্থান সৃষ্টি সম্ভব নয়। মিসেস তানজিমা মোস্তফা বলেন, স্থানীয় ব্যাংকের অনেক লেটার অফ ক্রেডিট (এলসি) বিদেশে প্রত্যাখ্যাত হচ্ছে। ফলে আমদানি খরচ বাড়ছে, যা শেষ পর্যন্ত ভোক্তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়।

