রাজস্ব আদায় কমে যাওয়া, আগের সরকারের নেওয়া ঋণ পরিশোধের চাপ এবং মূল্যস্ফীতির কারণে পণ্য-সেবার দাম বেড়ে যাওয়ায় তীব্র আর্থিক সংকটে পড়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। এই সংকট মোকাবিলায় সরকার এখন ঋণের ওপরই নির্ভর করছে। চলতি ব্যয় নির্বাহ ও পরিকল্পিত খরচ মেটাতেও সরকারের ভরসা অভ্যন্তরীণ ঋণ। ফলে কৃচ্ছসাধনের নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। উন্নয়ন ব্যয় অনেক কমিয়ে আনা হলেও সরকারি ঋণ বেড়েই চলেছে।
অন্যদিকে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমছে। সরকারি খাতে ঋণ বাড়ায় সামগ্রিকভাবে অভ্যন্তরীণ ঋণপ্রবাহে সামান্য বৃদ্ধি দেখা গেলেও বেসরকারি খাতের গতি শ্লথ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের জুলাই-আগস্টে সরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ বেড়েছে ১ দশমিক ৭৯ শতাংশ। বিপরীতে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমেছে দশমিক ০৩ শতাংশ। অর্থাৎ, অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে বেসরকারি ঋণপ্রবাহ নেতিবাচক অবস্থায় রয়েছে।
রপ্তানি, শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা এবং দীর্ঘদিনের মন্দা বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহে প্রভাব ফেলছে। গত বছরের জুলাইয়ে ছাত্র-জনতার আন্দোলন শুরুর পর এই মন্দা আরও গভীর হয়, যা এখনও কাটেনি। রাজস্ব আয়ও আশানুরূপ নয়। দীর্ঘ অর্থনৈতিক মন্দা এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সংস্কার আন্দোলনের কারণে আদায়ে বাধা সৃষ্টি হয়েছে। যদিও গত অর্থবছরের তুলনায় চলতি অর্থবছরের জুলাই-আগস্টে রাজস্ব আয় বেড়েছে ২১ শতাংশ, তবু লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ঘাটতি রয়ে গেছে।
এই দুই মাসে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ছিল ৬১ হাজার ২৬ কোটি টাকা, আদায় হয়েছে ৫৪ হাজার ৪২৩ কোটি টাকা। ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ৫৭৭ কোটি টাকায়, যা প্রায় ১১ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই সময়ে আদায় হয়েছিল ৪৫ হাজার ৫ কোটি টাকা। সরকারের আয় বাড়ছে না, অথচ খরচ বেড়েছে সব খাতেই। এতে বড় ধরনের ঘাটতিতে পড়তে হচ্ছে সরকারকে। এই ঘাটতি পূরণে বাড়ছে ঋণনির্ভরতা, কিন্তু ব্যাংকিং খাতে তারল্য সংকট, উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও অর্থনৈতিক মন্দার কারণে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকেও প্রয়োজনীয় ঋণ জোগাড় কঠিন হয়ে পড়েছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, আগস্টের শেষে ব্যাংক খাতে আমানত বেড়েছে মাত্র ১ দশমিক ৪৪ শতাংশ। যা তারল্য বাড়ানোর জন্য যথেষ্ট নয়। এর মধ্যে মেয়াদি আমানত বেড়েছে, কিন্তু চলতি আমানত কমেছে—যা ব্যবসা-বাণিজ্যের ধীরগতির ইঙ্গিত দেয়। দেশের মোট অভ্যন্তরীণ ঋণের ২৮ শতাংশ সরকারি খাতে এবং ৭২ শতাংশ বেসরকারি খাতে। মোট অভ্যন্তরীণ ঋণের স্থিতি ২৩ লাখ কোটি টাকার মধ্যে বেসরকারি খাতে আছে সাড়ে ১৭ লাখ কোটি, সরকারি খাতে সাড়ে ৫ লাখ কোটি টাকা। বেসরকারি ঋণ কমলেও সরকারি ঋণ বাড়ায় মোট ঋণপ্রবাহ বেড়েছে দশমিক ৩৬ শতাংশ। তবে এই ঋণের প্রভাব উৎপাদন বা কর্মসংস্থানে পড়ছে না, কারণ এটি মূলত সরকারের চলতি ব্যয় নির্বাহে ব্যয় হচ্ছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, সরকারি খাতে ঋণ বৃদ্ধির মূল কারণ তিনটি—রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি, আগের সরকারের নেওয়া বিপুল ঋণ পরিশোধ এবং অতিরিক্ত ব্যয়। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে দেশি-বিদেশি উৎস থেকে নেওয়া স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণ পরিশোধ করা যায়নি। মেয়াদ বাড়াতে গিয়ে সেই ঋণের ওপর সুদ ও দণ্ড সুদ বেড়েছে। এখন ওই ঋণ পরিশোধের ভার পড়েছে বর্তমান সরকারের ওপর। ফলে রাজস্ব ঘাটতি ও ঋণ পরিশোধ—দুটোর চাপ মিলিয়ে আর্থিক সংকট চরমে পৌঁছেছে।
বর্তমানে সরকার চলতি ব্যয় মেটাচ্ছে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগীদের দেওয়া স্বল্পসুদে ঋণের টাকায়। সংকট গভীর হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকেও ছাপানো টাকায় সাময়িক ঋণ নিতে হচ্ছে, যদিও তা স্বল্প সময়ের মধ্যে ফেরত দেওয়া হয়।

