দেশে পাবলিক বাসে যাতায়াতের সময় যৌন হয়রানির শিকার হয়নি এমন মেয়ে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। মহাসড়ক, ফুটপাত বা জনসমাগমপূর্ণ এলাকায় দৈনন্দিন চলাফেরার সময় ঠিক কতজন নারী যৌন হেনস্তার সম্মুখীন হন, তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই।
গণপরিবহন, জনসমাবেশ বা সাধারণ রাস্তা-ঘাটে নারীরা শুধু উত্ত্যক্ত হন না, বরং তারা নিগৃহীত, যৌন হয়রানি বা যৌন নিপীড়নের শিকারও হন অর্থাৎ, অনেক ক্ষেত্রে উত্ত্যক্তের আড়ালে লুকিয়ে থাকে যৌন প্রবৃত্তির প্রকৃত রূপ। মনস্তাত্ত্বিকভাবে এটি এক ধরনের ইউফেমিজম। বখাটেদের যৌন হয়রানির আড়ালে থাকা লালসার প্রবণতা সামাজিকভাবে বা জন সাধারণের চোখে সহজে দৃশ্যমান হয় না। এই আড়ালে থাকা যন্ত্রণার অনুভূতি বোঝেন শুধুমাত্র ভুক্তভোগী নারী। এ ধরনের উত্ত্যক্ত নারীর স্বাধীন ও নিরাপদে চলার মৌলিক অধিকারের ওপর সরাসরি আঘাত হানে। এটি সংবিধান লঙ্ঘনের শামিল। গণপরিবহন বা অন্যান্য যানবাহনে চলার সময় প্রায়ই এ ধরনের অপ্রীতিকর অভিজ্ঞতার খবর শোনা যায়।
গণপরিবহনে যৌন হয়রানি ও হেনস্থার ভয়াবহ চিত্র:
গণপরিবহনে নানা ধরনের মানুষের সমাগম হয়। তবে এর অর্থ এই নয় যে যেকোনো স্পর্শকেই যৌন হয়রানি বা হেনস্থা বলা যাবে না। শারীরিক যৌন হয়রানির মধ্যে রয়েছে ইচ্ছাকৃতভাবে বারবার স্পর্শ করা, চিমটি কাটা, কাছ ঘেঁষে দাঁড়ানো বা আস্তে ধাক্কা দেওয়া। এছাড়া নারীদের চুল স্পর্শ করা, কাঁধে হাত রাখা, সংবেদনশীল স্থানে স্পর্শ করা, গায়ের সাথে ঘষাঘষি করা, চোখ টিপ মারা, জিহ্বা বের করে বাজে ইঙ্গিত দেওয়া বা কাপড় ছিঁড়ে দেওয়া অন্তর্ভুক্ত। এমনকি বাসের সিটে চুইংগাম লাগিয়ে ইচ্ছাকৃত হেনস্তাও এর অংশ।
গণপরিবহন ব্যবহারের সময় ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির খবর আমরা প্রায়ই শুনি। তবে এটি যেন অভ্যস্ততায় পরিণত হয়ে গেছে। কখনো কখনো এসব ঘটনায় ব্যাপক প্রতিবাদও হয়। কিন্তু এর মাত্রা এবং প্রকৃতি আমরা সবসময় পুরোপুরি বুঝতে পারি না। সম্প্রতি অ্যাকশন এইড বাংলাদেশ এবং ব্র্যাকের দুটি গবেষণায় এই সমস্যার ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে। অ্যাকশন এইড বাংলাদেশ-এর ‘সেফ সিটিজ ফর উইমেন’ শিরোনামের গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশের শতকরা ৮৮ শতাংশ নারী রাস্তায় চলার সময় যৌন হয়রানিমূলক মন্তব্যের মুখোমুখি হন। এর মধ্যে ৮৬ শতাংশ ঘটনা ঘটে গণপরিবহণের চালক ও হেলপারদের দ্বারা। শারীরিক যৌন হয়রানির পাশাপাশি মানসিক যৌন হয়রানি সচেতনতার বাইরে রয়েছে। এটি দ্রুত ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। শিকার নারীরাও ঠিক জানেন না কোথায় ও কীভাবে এর প্রতিকার পাওয়া যাবে।
গণপরিবহনে যৌন হয়রানির শিকার হলে নারীর করণীয়:
অনলাইন একটি সার্ভে থেকে জানা গেছে, বাসে যৌন হয়রানির শিকার হলে ৮১ শতাংশ নারী চুপচাপ থাকেন বা নিরবে তা সহ্য করেন। ৭৯ শতাংশ জানান, তারা আক্রান্ত হওয়ার স্থান থেকে সরে যান অথবা না দেখার ভান করেন। মনস্তাত্ত্বিকভাবে এটি মানসিক যন্ত্রণা দেয়। যারা যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করতে পারেন না, তারা হীনমন্যতার শিকার হন। যদিও নারী নিপীড়নের বিষয়টি গণমাধ্যম বা আইনে গুরুত্ব পায়, গণপরিবহনে নারীর সঙ্গে ঘটে এমন যৌন নির্যাতন খুব কমই নজরে আসে। এই ধরনের সমস্যায় নারীর পাশে থাকা যাত্রী এবং গাড়ির অন্যান্য যাত্রীদের সহায়তা প্রয়োজন।
যৌন হয়রানির শিকার হলে অভিযোগ করার উপায়:
জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯: ৯৯৯ বাংলাদেশ পুলিশের অধীনে পরিচালিত একটি জরুরি কল সেন্টার। এটি সপ্তাহে ৭ দিন, ২৪ ঘণ্টা চালু থাকে। দেশের যে কোনো প্রান্ত থেকে কেউ ৯৯৯-এ কল করে জরুরি সেবা পেতে পারেন। চলন্ত গাড়িতে যৌন হয়রানির শিকার হলে সেই মুহূর্তে ৯৯৯-এ কল করে অভিযোগ করা যায়। এই সেবা ২০১৭ সালের ১২ ডিসেম্বর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে চালু করা হয়েছে। কল সম্পূর্ণ টোল ফ্রি, অর্থাৎ মোবাইলে টাকা না থাকলেও কল করা সম্ভব।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন জাতীয় হেল্পলাইন ১০৯: মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে রাত-দিন ২৪ ঘণ্টা এই হেল্পলাইন চালু আছে। এখানে গণপরিবহন বা বাসে যাতায়াতের সময় নির্যাতনের শিকার কেউ জানাতে পারেন। এই দুই চ্যানেলের মাধ্যমে শিকার নারী বা যেকোনো নাগরিক তৎক্ষণাৎ সহায়তা নিতে পারেন এবং ঘটনার যথাযথ প্রতিকার নিশ্চিত করতে পারেন।
মেয়েদের সুরক্ষায় ‘বাঁচাও’ অ্যাপ ও আইনের সাহায্য:
‘বাঁচাও’ অ্যাপ: ‘বাঁচাও’ মূলত একটি স্মার্টফোন অ্যাপ। বিপদের মুহূর্তে নারীরা এক ক্লিকে সাহায্য চাওয়া বার্তা পাঠাতে পারবেন। এই বার্তা নারীর কাছে থাকা পরিবার, বন্ধু, স্বেচ্ছাসেবক ও পুলিশের কাছে পৌঁছাবে। জিপিএস প্রযুক্তি ব্যবহার করে নারীর অবস্থান চিহ্নিত করা যাবে। বার্তা পাঠানো যাবে টেক্সট বা অডিও কলের মাধ্যমে, তার নম্বর গোপন রেখে।
ভ্রাম্যমাণ আদালত: ভ্রাম্যমাণ আদালত আয়োজন করা হলে নারীরা সঙ্গে সঙ্গে তাদের বিষয়টি জানাতে পারবেন। যদি আদালত হাতেনাতে প্রমাণ পান, তাহলে ঘটনাস্থলেই শাস্তি আরোপ করা সম্ভব।
আইনের প্রেক্ষাপট: বাংলাদেশে গণপরিবহন বা বাসে ইভটিজিং বা যৌন হয়রানির শাস্তির বিধান রয়েছে।
-
দণ্ডবিধি, ১৮৬০, ধারা ৫০৯: ইভটিজিং প্রমাণিত হলে এক বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড, অর্থদণ্ড বা উভয় শাস্তি হতে পারে।
-
ধারা ২৯৪: অপরাধ প্রমাণিত হলে তিন মাস পর্যন্ত কারাদণ্ড, অর্থদণ্ড বা উভয় শাস্তি হতে পারে।
-
ধারা ৩৫৪: যদি কোনো ব্যক্তি নারীর শালীনতা নষ্ট করার উদ্দেশ্যে আক্রমণ বা অপরাধমূলক বল প্রয়োগ করে, তাহলে দুই বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড, অর্থদণ্ড বা উভয় শাস্তি হতে পারে। এই অ্যাপ, ভ্রাম্যমাণ আদালত ও আইনের সমন্বয় নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ অধ্যাদেশের ৭৫ ও ৭৬ ধারায় ইভটিজিং বা উত্যক্তার বিষয়ে নিয়ম রয়েছে। ধারা ৭৫ অনুযায়ী সমাজে অশালীন বা উচ্ছৃঙ্খল আচরণের জন্য সর্বোচ্চ তিন মাসের কারাদণ্ড, ৫০০ টাকা জরিমানা বা উভয় শাস্তি হতে পারে। ধারা ৭৬ অনুযায়ী শাস্তি এক বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড, দুই হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় হতে পারে।
ফিরে দেখা কিছু ঘটনা:
চলতি বছরের ১৫ নভেম্বর রাতে চট্টগ্রাম থেকে সিলেটগামী একটি নাইট কোচে এক তরুণীকে পর্ন ভিডিও দেখানো ও উত্যক্ত করার ঘটনায় এক যুবককে ভ্রাম্যমাণ আদালত তিন মাসের কারাদণ্ড ও ১০ হাজার টাকা জরিমানা দিয়েছেন। ২০১৯ সালের ১০ আগস্ট রাতে চট্টগ্রাম মহানগরের চলন্ত বাসে এক গৃহবধূকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়। তার চিৎকারে পেছনে থাকা একটি ট্রাকের চালক বাসের গতি থামান। স্থানীয়রা বাসের চালক ও সহকারীকে আটক করে পুলিশের হাতে তুলে দেন। ২০১৯ সালের ২৪ জানুয়ারি আশুলিয়ার বাইপাইল এলাকায় একটি পোশাককর্মী বাস ধরার সময় পিকআপ ভ্যানের চালক তাকে তুলে নিয়ে পরে ধর্ষণ করে ফেলে।
২০১৮ সালের এপ্রিল মাসে লাব্বাইক পরিবহনের একটি বাসে বাংলাদেশ লেদার টেকনোলজি ইনস্টিটিউটের এক ছাত্রীকে পরিবহনশ্রমিকেরা যৌন হয়রানির চেষ্টা করেন। একই বছরের মার্চ মাসে নিউ ভিশন নামে একটি বাসে দুই নারীকে যৌন হয়রানির চেষ্টা করা হয়। একই মাসে এক কলেজছাত্রী একটি ফাঁকা বাসে উঠলে একই ধরনের ঘটনার শিকার হন। শুধু বাসে নয়, নারীরা মার্কেট, পথঘাট ও কর্মস্থলে যৌন হয়রানি ও ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন।
২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট বগুড়ায় পরীক্ষা দিয়ে ময়মনসিংহগামী বাসে যাওয়ার পথে জাকিয়া সুলতানা রূপা নামে এক কলেজছাত্রীকে গণধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। গাড়ির চালক, তার সহকারী ও সুপারভাইজর এই জঘন্য অপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ঘটনার পর রূপার লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্ত শেষে বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে টাঙ্গাইলে দাফন করা হয়। এই ঘটনার কারণে দেশজুড়ে ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। দায়েরকৃত মামলায় ২০১৮ সালে চারজনের ফাঁসির আদেশ দেয় আদালত।
পরিশেষে, গণপরিবহনে বা বাসে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা প্রয়োজন। পরিবহন শ্রমিক এবং সাধারণ যাত্রীদের করণীয় ও না করণীয় সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ক্লাসরুমে যৌন হয়রানি নিয়ে আলোচনা করা এবং নেতিবাচক প্রভাব তুলে ধরা জরুরি। ইদানীং দেখা যাচ্ছে, নারীরা সাহস দেখিয়ে এসব ঘটনার প্রতিবাদ করতে শুরু করেছেন। এটি আশা জাগানোর বিষয়। তবে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিচার ও শাস্তি নিশ্চিত করা সরকারের এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্ব।
নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নারীবান্ধব যানবাহন, নিরাপদ চালক ও সহকারী থাকা জরুরি। পাশাপাশি যাত্রীদের মানসিকতাতেও পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। নারী নিরাপত্তা সংক্রান্ত অন্যান্য কার্যক্রমের সঙ্গে নারী গাড়িচালক প্রশিক্ষণের দিকে নজর দেওয়া উচিত। আমাদের লক্ষ্য এমন একটি দেশ যেখানে প্রতিটি নারীর পথচলা হবে নিরাপদ ও সুন্দর।

