বছরের শুরুতেই একজন জনপ্রিয় ভারতীয় ট্রাভেল ইনফ্লুয়েন্সারের একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে সোশ্যাল মিডিয়ায়। সেখানে তাঁকে বলতে দেখা যায়—“আমরা বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতি, কিন্তু আমাদের পাসপোর্ট দিয়ে এখনো ইউরোপ বা আমেরিকায় ভিসা পাওয়া যুদ্ধের মতো কঠিন।”
তার সেই আক্ষেপ যেন বাস্তবেই ফুটে উঠেছে হেনলি পাসপোর্ট ইনডেক্স ২০২৫–এর সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে।
বিশ্বের ১৯০টি পাসপোর্টের মধ্যে ভারত এবার নেমে গেছে ৮৫তম স্থানে, যা গত বছরের তুলনায় পাঁচ ধাপ নিচে। অথচ ভারতের চেয়ে অনেক ছোট ও তুলনামূলক কম প্রভাবশালী অর্থনীতি—যেমন রুয়ান্ডা (৭৮তম), ঘানা (৭৪তম) ও আজারবাইজান (৭২তম)—সবই ভারতের ওপরে অবস্থান করছে।
হেনলি পাসপোর্ট ইনডেক্সে শীর্ষে আছে সিঙ্গাপুর, যার নাগরিকরা ১৯৩টি দেশে ভিসা ছাড়াই ভ্রমণ করতে পারেন। দ্বিতীয় স্থানে দক্ষিণ কোরিয়া (১৯০ দেশ), তৃতীয় স্থানে জাপান (১৮৯ দেশ)।
আর ভারত? তার নাগরিকরা ভিসা ছাড়াই যেতে পারেন মাত্র ৫৭টি দেশে—যা আফ্রিকার ছোট দেশ মৌরিতানিয়ার সমান।
এমনকি ২০২১ সালেও ভারতের র্যাঙ্কিং ৯০তম স্থানে নেমে গিয়েছিল, পরে সামান্য উন্নতি হলেও এখন আবার নামছে নিচে। গত জুলাইয়ে ভারত ছিল ৭৭তম, কিন্তু অক্টোবরে দুটি দেশের ভিসামুক্ত প্রবেশাধিকার হারানোর পর আবার ৮৫তম স্থানে নেমে আসে।
অনেকে ভাবতে পারেন—২০১৫ সালে ভারতীয়রা যেখানে ৫২টি দেশে ভিসা ছাড়াই যেতে পারতেন, এখন তা বেড়ে ৫৭-তে পৌঁছেছে; তাহলে র্যাঙ্কিং কমবে কেন?
বিশেষজ্ঞদের মতে, এর কারণ বিশ্বজুড়ে “ভ্রমণ প্রতিযোগিতা” বৃদ্ধি।
২০০৬ সালে যেখানে গড়পড়তা একজন মানুষ ভিসা ছাড়া যেতে পারতেন ৫৮টি দেশে, ২০২৫ সালে সেই সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ১০৯টি। অর্থাৎ, প্রায় সব দেশই তাদের নাগরিকদের জন্য নতুন ভিসামুক্ত চুক্তি করছে, আর এই বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় ভারত পিছিয়ে পড়ছে।
চীনের উদাহরণই যথেষ্ট। গত এক দশকে চীনা নাগরিকদের ভিসামুক্ত প্রবেশাধিকার বেড়েছে ৫০ থেকে ৮২ দেশে, আর র্যাঙ্কিং এক লাফে ৯৪ থেকে ৬০-এ উঠে গেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পাসপোর্টের শক্তি কোনো দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার চেয়ে বেশি কিছু বোঝায়—এটি বলে দেয় দেশটির ‘সফট পাওয়ার’ ও কূটনৈতিক প্রভাব কতটা কার্যকর।
একটি শক্তিশালী পাসপোর্ট মানে নাগরিকদের জন্য বেশি সুযোগ—ভ্রমণ, ব্যবসা, শিক্ষা ও আন্তর্জাতিক সংযোগে সহজ প্রবেশ।
অন্যদিকে দুর্বল পাসপোর্ট মানে অতিরিক্ত কাগজপত্র, বেশি ভিসা ফি, সময়ক্ষেপণ ও অস্বস্তিকর প্রক্রিয়া—যা এক পর্যায়ে দেশটির আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তিতেও প্রভাব ফেলে।
আর্মেনিয়ায় ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত অচল মালহোত্রা মনে করেন, ভারতের পাসপোর্ট দুর্বল হওয়ার পেছনে কেবল ভিসানীতি নয়, আছে রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতাও।
তিনি বলেন, “১৯৭০-এর দশকে ভারতীয়রা অনেক পশ্চিমা দেশে ভিসামুক্ত ভ্রমণ করতে পারতেন। কিন্তু ১৯৮০-এর দশকের খালিস্তান আন্দোলন, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অভিবাসন সংকট ভারতের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত করে।”
আজও অনেক দেশ ভারতীয় অভিবাসীদের বিষয়ে সতর্ক। বিপুল সংখ্যক ভারতীয় বিদেশে গিয়ে ভিসার মেয়াদ শেষ হলেও ফিরে আসেন না—এটি অভিবাসন আইন লঙ্ঘন হিসেবে দেখা হয় এবং দেশের ইমেজ ক্ষুণ্ণ করে।
২০২৪ সালে দিল্লি পুলিশ ২০৩ জনকে পাসপোর্ট জালিয়াতির অভিযোগে গ্রেপ্তার করে।এই ধরনের ঘটনা আন্তর্জাতিকভাবে ভারতের পাসপোর্টের নিরাপত্তা নিয়ে সন্দেহ তৈরি করে।এছাড়া দেশটির অভিবাসন প্রক্রিয়া এখনও ধীরগতি ও জটিল বলে সমালোচিত।
যদিও সম্প্রতি চালু হওয়া ই-পাসপোর্ট ব্যবস্থা কিছুটা আশার আলো দেখাচ্ছে। নতুন পাসপোর্টে একটি মাইক্রোচিপে বায়োমেট্রিক তথ্য সংরক্ষিত থাকে, যা জালিয়াতি রোধে সহায়ক হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিশ্লেষকদের মতে, ভারতের পাসপোর্ট শক্তিশালী করতে হলে শুধু প্রযুক্তিগত উন্নয়ন নয়, প্রয়োজন আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক তৎপরতা।
যত বেশি দেশ ভারতীয়দের সঙ্গে ভিসা-মুক্ত বা অন-অ্যারাইভাল চুক্তি করবে, তত দ্রুত ভারতের র্যাঙ্কিং উন্নতি করবে।
মালহোত্রা বলেন, “পাসপোর্টের শক্তি শুধু অর্থনীতির নয়, সম্পর্কেরও প্রতিফলন। যারা বিশ্ব রাজনীতিতে সহযোগিতার পরিবেশ তৈরি করে, তারাই নাগরিকদের বেশি ভ্রমণ স্বাধীনতা দিতে পারে।”
বিশ্ব যখন সীমান্ত খুলছে, কূটনীতি আরও মানবিক ও সংযোগনির্ভর হচ্ছে, সেখানে ভারতের মতো দেশের জন্য এটি ভাবনার সময়।
বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতি হয়েও যদি তাদের নাগরিকরা এখনও ভিসা কিউয়ের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকে—তাহলে সেটি শুধু ভ্রমণ সমস্যাই নয়, বরং একটি বৃহত্তর বৈদেশিক নীতির সীমাবদ্ধতার প্রতিচ্ছবি।

