বাংলাদেশের অর্থনীতি দীর্ঘ সময় নানা গভীর সমস্যার মুখোমুখি ছিল। সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় কিছুটা উন্নতি হয়েছে। এর প্রভাব স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রার খাতে। মূল লক্ষ্য ছিল বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখা। এই লক্ষ্য মোটামুটি সফলভাবে অর্জন করা গেছে।
অর্থনীতি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে হলে প্রথমে বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখতে হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখানে স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে। “ধরেবেঁধে রাখার কথা নয়, স্থিতিশীল রাখার কথা বলছি,” এমন মন্তব্য করেছেন অর্থনৈতিক নেতৃত্ব। এই ক্ষেত্রে দেশের অর্থনীতি কিছুটা সাফল্য দাবি করতে পারে। আগে বিদেশী ব্যাংকগুলো বাংলাদেশের ক্রেডিট লিমিট কমিয়ে দিত বা বন্ধ করে দিত। এখন সেই সব লিমিট পুনরায় খুলে দেওয়া হয়েছে। ব্যাংকগুলো রিইন্স্যুরেন্সসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে না। কিছু ক্ষেত্রে তারা আরও বেশি ক্রেডিট পাচ্ছে।
অতীতের মতো আর ‘টাকা দিচ্ছেন না কেন?’—ধরনের অভিযোগ নেই। প্রায় সাড়ে তিন বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক পাওনা পরিশোধ সম্পন্ন হয়েছে। এতে দেশের অর্থনীতি আরও দৃঢ় হয়েছে এবং বৈদেশিক লেনদেন স্থিতিশীল হয়েছে। বাংলাদেশের কারেন্ট অ্যাকাউন্ট এখন সারপ্লাসে রয়েছে। গত বছর ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্টেও সামান্য সারপ্লাস ছিল। এ হিসেবে দেশের এক্সটারনাল সেক্টর স্থিতিশীল এবং কোনো দুর্বলতা নেই।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, আমদানির ক্ষেত্রে যা ইচ্ছা, তা করা সম্ভব। কেউ যদি বলেন তারা আমদানি করতে পারছেন না, সেটা তাদের নিজস্ব সমস্যা। দেশে ডলারের কোনো ঘাটতি নেই। বাজারে ইচ্ছামতো ডলার কেনা সম্ভব। বাংলাদেশ ব্যাংক সব বাধ্যতামূলক মার্জিন তুলে দিয়েছে। এখন ব্যাংক ও ক্লায়েন্টের সম্পর্কের ভিত্তিতে ব্যবসা করার সুযোগ আছে। এ কারণে দেশের ব্যবসায়িক খাতে স্বস্তির অবস্থান তৈরি হয়েছে। গভর্নর হিসেবে যোগদানের সময় ডলারের দাম ছিল ১২০ টাকা। এখন তা ১২২ টাকায় স্থিতিশীল রয়েছে। একই সময়ে ভারতে ডলারের দাম ৮৪ থেকে ৮৯ রুপিতে বেড়েছে। অর্থাৎ বাংলাদেশের বাজারে ডলারের দাম তুলনামূলকভাবে বেশি স্থিতিশীল।
গত ১৫ মাসে ডলারের মান কিছুটা অবমূল্যায়ন করা হয়েছে। তবে ডলারের অতিরিক্ত স্থিতিশীলতা বা জোর করে দাম ধরে রাখাকে ভালো মনে করা হয় না। বাংলাদেশ ব্যাংক এখন ডলারের দর নির্ধারণে হস্তক্ষেপ করছে না। সম্পূর্ণ বাজারভিত্তিকভাবে সরবরাহ ও চাহিদার ওপর ভিত্তি করে ডলারের মূল্য নির্ধারিত হচ্ছে। গত রমজান মাসটা অর্থনৈতিকভাবে কিছুটা কঠিন ছিল। তখনও পর্যাপ্ত বৈদেশিক মুদ্রা দিয়ে সরবরাহ ঠিক রাখা হয়েছিল। এবারের রমজানকে সামনে রেখেও এখন পর্যন্ত কোনো ঝুঁকির ইঙ্গিত দেখা দেয়নি। রমজানের প্রয়োজনীয় সব পণ্যের এলসি ইতোমধ্যেই খোলা হয়েছে। অনেক পণ্যের ক্ষেত্রে এলসি খোলার হার গত বছরের তুলনায় ১৫-২০ শতাংশ বেশি। ফলে আমদানি বেড়েছে, তবু ডলারের ওপর চাপ পড়ছে না।
চলতি বছরে আমদানি প্রবৃদ্ধি হয়েছে দুই অংকের হারে। তবে বিনিময় হার এখনও স্থিতিশীল। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এটি দেশের জন্য স্বস্তির বিষয়। কিছু স্বস্তি থাকলেও দেশের অর্থনীতির সমস্যা অনেক। এগুলো রাতারাতি সমাধান হবে না। এখনো অনেক ক্ষেত্রেই সমস্যাগুলো শনাক্ত করা হচ্ছে। তার মধ্যে খেলাপি ঋণ সবচেয়ে বড় সমস্যা। নতুন নীতি ও প্রতি প্রান্তিকে হালনাগাদ তথ্য আসার কারণে ব্যাংক খাতের এনপিএলের প্রকৃত পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে। গত সরকার এনপিএল ৮ শতাংশ বলেছিল। বর্তমান গভর্নর অনুমান করেছিলেন আসল হার ২৫ শতাংশ। বাস্তবে তা এখন ৩৫ শতাংশ। এটি কোনো ছোট সমস্যা নয়। এক-তৃতীয়াংশের বেশি ঋণ মন্দ ঋণ হলে বাকি দুই-তৃতীয়াংশের ওপর ভিত্তি করে ব্যাংক চালানো বড় চাপের। ব্যাংক ও আর্থিক খাত দীর্ঘদিন ধরে এই সমস্যায় ভুগছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ক্ষত সারাতে কমপক্ষে ৫-১০ বছর সময় লাগবে।
সুদের হার কিছুটা বেশি, এ অস্বীকার করার সুযোগ নেই। তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটও গুরুত্বপূর্ণ। গত বছরের আগস্টে যোগদানের সময় মূল্যস্ফীতি সাড়ে ১২ শতাংশ ছিল। সে তুলনায় নীতি সুদহার ১০ শতাংশ বেশি নয়। বিশ্বে ভারত, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে মূল্যস্ফীতি ও নীতি সুদহারের ব্যবধান সাধারণত আড়াই থেকে তিন শতাংশ থাকে। আমাদের লক্ষ্যও তাই। বর্তমানে দেশের মূল্যস্ফীতি ৮.২ শতাংশ। যদি এটি ৭ শতাংশ বা তার নিচে নেমে যেত, নীতি সুদহার কমানো সম্ভব হত। তবে কিছু নীতিগত ব্যর্থতার কারণে তা সম্ভব হয়নি। চলতি বছরের আগস্ট-সেপ্টেম্বরে দেশের চালের দাম ১৮ শতাংশ বেড়ে মূল্যস্ফীতি ১.৪ শতাংশ পয়েন্ট বৃদ্ধি পেয়েছিল। বিশ্বের অন্যান্য দেশে এমন হয়নি। ভারতে তো দাম বাড়েনি। আমরা আমদানি সীমিত রাখায় বাজারে চাপ সৃষ্টি হয়েছিল।
পরবর্তীতে আমদানি শুরু হলেও তা আমন মৌসুমের আগে হয়েছিল, অনেকটা দেরিতে। বাজার মনিটরিং বা প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ সবসময় কার্যকর নয়। সরবরাহ চেইন এবং পণ্যমূল্য মনিটরিং করা গেলে বাজার আরো স্থিতিশীল রাখা সম্ভব। ভোজ্যতেলের ক্ষেত্রেও একই সমস্যা দেখা যায়। সরকার যখন বাজারে দাম নির্ধারণ করে, বাজার থেকে ভোজ্যতেল সরবরাহ কমে যায়। দাম বেঁধে দেয়ার কারণে কখনো বাজারে অস্থিরতা দেখা দেয়। পরে কিছুদিন বিক্রি বন্ধ রাখে সরকার এবং দাম বাড়িয়ে বাজার সচল করে। এমন প্রক্রিয়ার বদলে বাজার উন্মুক্ত রাখা হলে সরবরাহ স্বাভাবিক থাকবে এবং অস্থিরতা কমবে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সরকারের নীতিগত কিছু পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। এতে বাজার স্থিতিশীল এবং সরবরাহ সচল রাখা সম্ভব হবে।
বাংলাদেশে আমানত প্রবৃদ্ধির হার সাম্প্রতিক সময়ে ৬ শতাংশ থেকে বেড়ে ১০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ভবিষ্যতে এটি আরও বাড়ার সম্ভাবনা আছে। তবে ব্যাংকের ওপর সরকারের ঋণ চাহিদা কমানো না হলে মানি মার্কেটে চাপ কমানো সম্ভব হবে না। ৬ শতাংশ আমানত থেকে যদি সরকারই ১ লাখ কোটি টাকা ঋণ নেন, তাহলে বেসরকারি খাতের জন্য অর্থের সুযোগ কমে যায়। বিশেষজ্ঞদের মতে, যদি আমানত প্রবৃদ্ধি ১৪ শতাংশে পৌঁছানো যায়, তাহলে বাজারে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা আসবে, যা পুরোপুরি বেসরকারি খাতের জন্য ব্যবহার করা যাবে। সরকার তো ঋণ নেবে, বেসরকারি খাতের জন্য অর্থ আসার একমাত্র পথ হলো আমানত প্রবৃদ্ধি।
দীর্ঘদিন আমানত প্রবৃদ্ধি না হওয়ার মূল কারণ ছিল অর্থ পাচার। অনেকেই মনে করেন, আমদানি কমে গেছে, কিন্তু বাস্তবে পণ্যের ভলিউম কমেনি। চট্টগ্রাম বন্দরের পরিসংখ্যান দেখানো হচ্ছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে রেকর্ড ভলিউমে আমদানি হয়েছে। ২০২৫-২৬ অর্থবছরে (জুলাই-অক্টোবর) পণ্য আমদানি পরিমাণে দুই অংকের হারে বেড়েছে। কনটেইনার শিপমেন্টও ৮.৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে আমদানি বিল কমেছে। এর কারণ হলো অর্থ পাচার কমে যাওয়া। আগে যেসব ওভার ইনভয়েসিং হতো, তা এখন কমেছে। অর্থাৎ, শুধুমাত্র পরিসংখ্যান দেখে সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক হবে না। পণ্যের ভলিউম এবং অর্থের বাস্তব চিত্র উভয়কেই বিবেচনা করতে হবে।
বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের মূল সমস্যা হলো কাঠামোগত দুর্বলতা। বন্ড মার্কেট নেই বললেই চলে, স্টক মার্কেট দুর্বল, ইন্স্যুরেন্স খাতও কঠিন অবস্থায়। ফলে সবাই ব্যাংকের ওপর নির্ভরশীল। বিশ্ববাজারের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায়, বৈশ্বিক বন্ড মার্কেটের আকার ১৩০ ট্রিলিয়ন ডলার, স্টক মার্কেটের আকার ৯০ ট্রিলিয়ন ডলার। ব্যাংক বা মানি মার্কেটের আকার মাত্র ৬০ ট্রিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ বিশ্বে বন্ড ও স্টক মার্কেট ব্যাংক খাতের চেয়ে বড়। কিন্তু আমাদের দেশে পুরো উল্টো। সবাই ব্যাংক থেকে অর্থ নিচ্ছে, ফলে ঝুঁকি বেড়েছে। সব অর্থনৈতিক চাপ ব্যাংকের ওপর পড়ছে, যা অসহনীয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্যাংক খাতনির্ভরতা কমানো না হলে শিল্প খাত বিকশিত হবে না। অন্য খাতগুলো বিকশিত না হওয়ার কারণে ব্যাংকের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়ছে। এজন্য বন্ড মার্কেট বিকাশ জরুরি। বাংলাদেশ ব্যাংক ইতিমধ্যেই নীতি গ্রহণ করেছে। বিএসইসির সঙ্গে আলোচনা হয়েছে, আর্থিক বিভাগের সঙ্গেও সমন্বয় করা হয়েছে। শিগগিরই বাস্তবায়ন কার্যক্রম শুরু হবে।
ব্যবসায়ীদেরও বার্তা দেওয়া হয়েছে—যাদের ব্যাংকের ওপর এক্সপোজার অনেক, তারা আর শুধুমাত্র ব্যাংকের দিকে তাকাবেন না। বাজার থেকে বন্ড সংগ্রহ করুন। ব্যাংক ১৫-২০ বছরের দীর্ঘমেয়াদি ঋণের জন্য উপযুক্ত নয়। সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যবসায়ীদের বন্ডে যেতে উৎসাহিত করবে। সাথে স্টক মার্কেটকেও পুনরুজ্জীবিত করতে হবে। বাজারে আস্থাহীনতা দূর করতে হবে। নতুন কোনো স্ক্যান্ডাল হলে অর্থনীতির ক্ষতি হতে পারে। তাই পুঁজিবাজারের স্থিতিশীলতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা জরুরি।
বাংলাদেশে ব্যাংক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য ১৪টি ব্যাংকের বোর্ড পরিবর্তন করা হয়েছে। এর ফলাফল ইতিমধ্যেই দেখা যাচ্ছে। ইসলামী ব্যাংকের অবস্থাও এখন অনেকটা স্বাভাবিক। ব্যাংকটিকে ১০ হাজার কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়েছিল, যা তারা ফেরত দিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্যাংক খাত ধ্বংস হয়নি, বরং দুটি ভাগে বিভক্ত হয়েছে—ভালোভাবে পরিচালিত ব্যাংক এবং সমস্যা আছে এমন ব্যাংক। যেখানে সমস্যা রয়েছে, সেখানে কেন্দ্রীয় ব্যাংক হস্তক্ষেপ করছে। ব্যাংক খাতে সুশাসন নিশ্চিত করতে বিভিন্ন আইনের খসড়া তৈরি করা হয়েছে। কিছু অধ্যাদেশ আকারে প্রকাশিত হয়েছে, কিছু এখনও পাইপলাইনে রয়েছে। রাজনীতিকদের কাছে অনুরোধ, এগুলো সংসদে পাস করে স্থায়িত্ব দিতে।
ব্যাংক কোম্পানি আইনে গুরুত্বপূর্ণ সংশোধন আনা হয়েছে। বোর্ডে অন্তত ৫০ শতাংশ স্বতন্ত্র পরিচালক থাকা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। পরিচালকের মেয়াদ ১২ বছর থেকে কমিয়ে ৬ বছর (৩ বছর করে) করা হয়েছে। পরিবারভিত্তিক মালিকানা ১০ শতাংশের বেশি হতে পারবে না (বিদেশী ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী ব্যতিক্রম)। ব্যাংকগুলোকে মালিক নয়, তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে কাজ করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের রাজনৈতিকীকরণ ব্যাংক খাতের দুরবস্থার পেছনের একটি বড় কারণ। বিশ্বের কোনো দেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বেতন কাঠামো সরকারের সঙ্গে মিলে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকে পেশাদারিত্ব বজায় রাখতে স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
অমানত সুরক্ষা স্কিম ১ লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২ লাখ টাকা করা হয়েছে। এনবিএফআইও এর আওতায় আসছে। খারাপ সম্পদ মূল্যায়নের জন্য অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি তৈরি করা হচ্ছে। বছরের পর বছর মামলা ঝুলে থাকা থেকে বাঁচতে অর্থঋণ আদালত কার্যকর করার পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। ব্যবসা বন্ধ হলে বাজার থেকে বের হওয়ার জন্য বৈধ প্রক্রিয়া নিশ্চিত করতে ব্যাংকরাপ্সি আইন আনা হচ্ছে।
বাংলাদেশে খারাপ ও অচল ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান নিয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। ব্যাংক রেজল্যুশন অধ্যাদেশের মাধ্যমে পাঁচ দুর্বল ব্যাংককে একত্র করে একটি শক্তিশালী নতুন ব্যাংক গঠন করা হচ্ছে। আশা করা যাচ্ছে, আগামী সপ্তাহে এর আনুষ্ঠানিক সূচনা হবে। নতুন ব্যাংকের পরিশোধিত মূলধন ৩৫ হাজার কোটি টাকা হবে এবং এটি দেশের সবচেয়ে বড় পুঁজিসংবলিত ব্যাংক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে। সরকার ২০ হাজার কোটি টাকা অর্থায়ন করছে।
ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জন্যও বেশ কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। নিয়মকানুনে পরিবর্তন এনে গ্যারান্টি ব্যবস্থাকে আরও উদার করা হয়েছে। এর লক্ষ্য, ব্যাংকগুলোকে গ্যারান্টি স্কিম ব্যবহার করতে উৎসাহিত করা এবং এসএমই খাতে আরও কার্যকরভাবে ঋণ বিতরণ নিশ্চিত করা। প্রয়োজনে ব্যাংকরা এনজিওদের সঙ্গে কাজ করে কৃষি ও এসএমই ঋণ বিতরণ করতে পারবে। বর্তমানে এসএমই খাতে ২৫ হাজার কোটি টাকা বিতরণ হয়নি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কৃষি খাতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে মাত্র ২ শতাংশ ঋণ যায়। অথচ দেশের অর্থনীতিতে কৃষির অবদান এখনো প্রায় ১৪ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের এখানে বড় ভূমিকা রাখা প্রয়োজন।
এনআরবিরা দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন। শুধুমাত্র রেমিট্যান্স নয়, বিনিয়োগের মাধ্যমেও প্রভাব বিস্তার করছেন। গভর্নর নিজেও প্রবাসী হিসেবে বিদেশে ৩২ বছর ছিলেন। তিনি বলছেন, বিদেশে থাকা মানেই চিরকাল সেখানে থাকতে হবে না। প্রবাসীরা নানাভাবে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ভূমিকা রাখতে পারেন। রাজনৈতিক নেতৃত্বদের লক্ষ্য স্পষ্ট—বাংলাদেশকে শিগগিরই ১ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতিতে উন্নীত করা। বর্তমানে দেশ প্রায় অর্ধ ট্রিলিয়নের কাছাকাছি। এই লক্ষ্য আমরা সমর্থন করি। তবে এটি অন্তর্ভুক্তিমূলক হতে হবে। কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং পরিবেশগত স্থায়িত্ব নিশ্চিত করতেও জোর দিতে হবে। আলোচনায় একমত হওয়া হয়েছে, দেশের আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও অদক্ষতা অর্থনৈতিক উৎপাদনশীলতাকে বাধাগ্রস্ত করছে এবং দুর্নীতিকে উৎসাহিত করছে। রাজনীতিকরা সমস্যা চিহ্নিত করেছেন, তবে সমাধানের কথা বলেননি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমলাতন্ত্রের সংকট রাজনীতিকদেরই সমাধান করতে হবে।
প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা ও ব্যর্থতার কথাও উঠে এসেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও নির্বাচন কমিশনের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব। বিগত সরকারগুলো এসব প্রতিষ্ঠানকে অপব্যবহার করায় তাদের কার্যকারিতা কমেছে। প্রতিষ্ঠান ছাড়া জনগণের কাছে ভালো সেবা পৌঁছে দেওয়া সম্ভব নয়। প্রশাসন ও পুলিশের সংস্কার না হওয়া পর্যন্ত জনগণকে সঠিক সেবা দেওয়া কঠিন। এজন্য ডিজিটাল ইকোনমি ও ডিজিটাল গভর্ন্যান্সে জোর দিতে হবে। ব্যক্তি হস্তক্ষেপ থাকলে জবাবদিহিতা দুর্বল হয় এবং দুর্নীতির সুযোগ তৈরি হয়।
অর্থনৈতিক ন্যায্যতার দিক থেকেও পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি এবং ন্যায্যতা—দুটোই জরুরি। বাংলাদেশ ব্যাংক আর্থিক অন্তর্ভুক্তিকে একটি চালিকাশক্তি হিসেবে গ্রহণ করেছে। বর্তমানে প্রায় ৬৬ শতাংশ মানুষ আনুষ্ঠানিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত। বাকি ৩৪ শতাংশকেও অন্তর্ভুক্ত করতে বিভিন্ন কৌশল নেওয়া হচ্ছে। আগামী পাঁচ থেকে দশ বছরের মধ্যে প্রতিটি পরিবার আনুষ্ঠানিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার অংশ হবে, এটাই লক্ষ্য। এজেন্ট ব্যাংকিং, মাইক্রোক্রেডিট এবং অটোমেশনের মাধ্যমে এই সেবা জনগণের দ্বারে পৌঁছে দেওয়া হবে। স্মার্টফোনকে আরও সহজলভ্য করার জন্য ৫-৬ হাজার টাকায় একটি স্মার্টফোন ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এ কাজে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) সহযোগিতা করছে। ব্যাংকগুলোর সঙ্গেও সমন্বয় করা হয়েছে। এর মাধ্যমে সবাইকে আনুষ্ঠানিকভাবে ব্যাংক খাতের সঙ্গে যুক্ত করা সম্ভব হবে।
দেশের হাজার হাজার কোটি টাকা লুট করে বিদেশে নিয়ে যাওয়া নিয়ে সরকারের পদক্ষেপ ইতিমধ্যেই অনেক দূর এগিয়েছে। তবে পরবর্তী সরকারকেও বিষয়টি এগিয়ে নিতে হবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজনৈতিক আপস করলে দেশের স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং ভুল উদাহরণ তৈরি হবে। নাগরিকদের দাবি, যারা দেশের সম্পদ লুট করেছে, তাদের কোনো ছাড় দেওয়া যাবে না। প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়নের অংশ হিসেবে এবং ভবিষ্যতে অর্থপাচার ও অর্থনৈতিক অপরাধ রোধে একটি নতুন প্রতিষ্ঠান গঠন করা হচ্ছে। এটি যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল ক্রাইম এজেন্সির মডেলে তৈরি হবে। প্রতিষ্ঠানের কাজ হবে অপরাধীদের দায়বদ্ধ করা এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনা। এ ছাড়া ফরেনসিক অডিট কার্যক্রমও শুরু হয়েছে। ইতিমধ্যেই কিছু ট্রেনিং শুরু হয়েছে। শিগগিরই পুরো অডিট সম্পন্ন করা হবে।
গভীর বিশ্লেষকরা বলছেন, আমাদের জীবদ্দশায় অনেক আন্দোলন-অভ্যুত্থান দেখেছে দেশ। তবে এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের প্রয়োজন। বর্তমান সরকার আংশিকভাবে হলেও যেসব সংস্কার করছে, পরবর্তী সরকার সেগুলোকে এগিয়ে নেবে—এটাই প্রত্যাশা। জবাবদিহি, স্বচ্ছতা, ক্ষমতার ভারসাম্য বজায় রাখা এবং প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়নের সংস্কৃতি গড়ে তোলা হবে। বারবার অভ্যুত্থান চাই না; চব্বিশের অভ্যুত্থান যেন আগামী দিনের শিক্ষা ও চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হিসেবে কাজ করে।
ড. আহসান এইচ মনসুর: বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর।

