বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা আজ এক জটিল সংকটের মুখোমুখি। প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত প্রতিটি স্তরে শিক্ষার গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন উঠছে, এবং এর পেছনে নানা প্রপঞ্চ কাজ করছে। তবে শিক্ষার এই বেহাল দশার জন্য শিক্ষকেরাও অনেকাংশে দায়ী। যদিও শিক্ষকতা এক মহান পেশা, এর প্রতি তাদের দায়বদ্ধতা অনেক বেশি। কিন্তু কিছু শিক্ষক তাঁদের দায়িত্ব ভুলে, নিজেদের স্বার্থ বড় করে দেখার চেষ্টায় লিপ্ত থাকেন। দলীয় রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়া, পদোন্নতির জন্য অপকৌশল গ্রহণ, দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়া—এসব কর্মকাণ্ড শিক্ষার মানকে নিম্নমুখী করছে। শিক্ষার্থীদের সাথে প্রতারণা, যৌন হয়রানির অভিযোগ এবং পরীক্ষার খাতায় নম্বর কম বা বেশি দেয়ার মতো অভিযোগও তাদের বিরুদ্ধে ওঠে।
প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতাও আজ তীব্র সংকটে। সমাজের অন্যান্য পেশার তুলনায় শিক্ষকদের আর্থিক ও সামাজিক মর্যাদা অনেক কম। এই বৈষম্য শিক্ষকদের মনোবল ভেঙে দেয় এবং শিক্ষার প্রতি তাদের উৎসাহ কমিয়ে দেয়। বিশেষ করে, দেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষকদের অবস্থা সবচেয়ে নাজুক। প্রাথমিক শিক্ষায় শিক্ষকগণ যে অল্প বেতনে কাজ করেন, তাতে তাঁরা জীবিকা নির্বাহ করতে হিমশিম খান। এর ফলে, শিক্ষকরা অন্য পেশার দিকে ঝুঁকতে বাধ্য হন। প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষকদের পেশাগত অবস্থা উন্নত করা না হলে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের শিক্ষার মান উন্নয়ন কল্পনাতীত।
মাধ্যমিক স্তরেও সমস্যা জটিল। সরকারি এবং বেসরকারি শিক্ষকদের বেতন বৈষম্য, পদোন্নতির অনিশ্চয়তা এবং এমপিওভুক্তির সমস্যার কারণে শিক্ষকরা হতাশায় ভুগছেন। অনেক শিক্ষক বছরের পর বছর ধরে এমপিওভুক্ত না হয়ে অর্ধ-বেকার অবস্থায় শিক্ষাদান করছেন। এমপিওভুক্তির তারিখ থেকে তাদের চাকরির অভিজ্ঞতা গণনা করা হলেও, অনেকের বেতন বা সুযোগ-সুবিধা পাওয়া হয় না। এমন অবস্থায়, অনেক মেধাবী শিক্ষিত ব্যক্তি শিক্ষকতা পেশায় আসতে অনাগ্রহ প্রকাশ করেন।

এ সংকটকে আরও প্রকট করেছে উচ্চশিক্ষার সংকট। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষকদের বেতন-ভাতা এবং পদোন্নতি ব্যবস্থা নিয়েও রয়েছে অসন্তোষ। উচ্চশিক্ষার শিক্ষকদের সম্মান এবং আর্থিক অবস্থার ওপর অনেকাংশে জাতির ভবিষ্যৎ নির্ভর করে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা, যারা একসময় নিজেও শিক্ষকের কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেছেন, এখন তারাই শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধা কমানোর জন্য কাজ করেন। শিক্ষাব্যবস্থার মান উন্নয়নে শিক্ষকদের আর্থিক এবং সামাজিক মর্যাদা ফিরিয়ে আনার জন্য রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ প্রয়োজন।
শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্ক যুগ যুগ ধরে একটি সমাজ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় এই সম্পর্কের ভাঙন আজ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। দেশের প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষকদের আর্থিক সংকট শিক্ষার মানকে ক্রমশ দুর্বল করে তুলছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন কম হওয়ায় অনেকেই শিক্ষকতার বাইরে অন্য কাজ করতে বাধ্য হন। অথচ প্রাথমিক বিদ্যালয়ই শিশুদের মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের প্রথম ধাপ। এই স্তরে সঠিক শিক্ষাদান না হলে, শিক্ষার্থীদের সারাজীবনের জন্য ঘাটতি তৈরি হয়। শিক্ষকদের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা না থাকলে, মানসম্মত শিক্ষা প্রদান সম্ভব নয়।
মাধ্যমিক স্তরেও পরিস্থিতি বেশ করুণ। সরকারি এবং বেসরকারি শিক্ষকদের মধ্যে বৈষম্য শিক্ষার প্রতি আগ্রহ কমিয়ে দিয়েছে। দেশের ২৬ হাজারেরও বেশি বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, কলেজ, এবং মাদ্রাসায় শিক্ষার্থীদের প্রায় ৯৫ শতাংশ পড়াশোনা করে। কিন্তু এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে কর্মরত ছয় লাখ শিক্ষকের মধ্যে অনেকেই এমপিওভুক্ত নন, যারা আরও বড় সমস্যার সম্মুখীন হন। যারা এমপিওভুক্ত হয়েছেন, তাদের মধ্যেও অনেকের চাকরি শুরু হওয়ার অনেক পর থেকে বেতন-ভাতা কার্যকর হয়। ফলে, অনেক শিক্ষক পেশার প্রতি উদাসীন হয়ে পড়েন। মেধাবী যুবসমাজ শিক্ষার প্রতি আকৃষ্ট হলেও, শিক্ষকতা পেশার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে শুধুমাত্র এই বৈষম্য এবং আর্থিক অনিশ্চয়তার কারণে।
উচ্চমাধ্যমিক স্তরের প্রভাষকদের পদোন্নতির সমস্যা বিশেষভাবে উদ্বেগজনক। আগে শিক্ষকদের পদোন্নতি সহজ ছিল, কিন্তু নতুন নিয়মের কারণে অনেক শিক্ষক জীবনের শেষ পর্যন্ত প্রভাষক পদেই থেকে যান। সহকারী অধ্যাপক কিংবা সহযোগী অধ্যাপক পদে পৌঁছানোর স্বপ্ন অধরাই থেকে যায়। বেসরকারি শিক্ষকদের জন্য পদোন্নতির এই জটিল নিয়ম শিক্ষকদের মনোবল ভেঙে দেয়, যা শিক্ষার্থীদের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়েও শিক্ষকদের আর্থিক ও সামাজিক সম্মান যথেষ্ট নয়। একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, যিনি গবেষণা কাজে নিয়োজিত থাকেন এবং সমাজকে আলোকিত করার চেষ্টা করেন, তাঁকেও সংসার চালানোর জন্য বিভিন্ন সংকটে পড়তে হয়। ফলে, তাদের কাজের প্রকৃত ফলাফল সমাজ পায় না। তাঁদের মেধার প্রকৃত প্রয়োগও সম্ভব হয় না। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা যখন নিজেদের বেতন-ভাতা এবং সুযোগ-সুবিধা নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকেন, তখন জাতি বড় কোনো আবিষ্কার কিংবা গবেষণায় অগ্রসর হতে পারে না। শিক্ষকদের আর্থিক নিরাপত্তা এবং সামাজিক মর্যাদা ফিরিয়ে না আনলে, শিক্ষার মানোন্নয়ন অসম্ভব।
শিক্ষাব্যবস্থার বর্তমান সংকট শুধু শিক্ষকদের আর্থিক দুরবস্থার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে শিক্ষকদের একাংশের নৈতিক অবক্ষয়ও। শিক্ষকদের মধ্যে কেউ কেউ নিজেদের স্বার্থকে বড় করে দেখে অনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়ছেন। দলীয় রাজনীতি, পদোন্নতির অপকৌশল, ঘুষ, দুর্নীতি—এসব কর্মকাণ্ড শিক্ষকদের সমাজে অসম্মানিত করছে। শিক্ষার্থী ও সমাজের কাছে তারা শিক্ষকের আদর্শিক ভাবমূর্তি হারিয়ে ফেলছে। একাংশের এই অযোগ্যতার কারণে শিক্ষাব্যবস্থার ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে।
শিক্ষকতা হলো একটি মহান পেশা, যার প্রধান দায়িত্ব শুধু পাঠদানেই সীমাবদ্ধ নয়। শিক্ষার্থীদের নৈতিক ও সামাজিক মূল্যবোধ গড়ে তোলা এবং পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সহায়তা করাও শিক্ষকের দায়িত্ব। একজন প্রকৃত শিক্ষক শুধুমাত্র জ্ঞান বিতরণ করেন না, শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস, মূল্যবোধ এবং চিন্তাশক্তির বীজ বপন করেন। কিন্তু যখন কোনো শিক্ষক এসব দায়িত্ব ভুলে যান, তখন তা শুধু শিক্ষার্থীদের জন্যই নয়, পুরো সমাজের জন্য ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়ায়।

বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে যখন আমরা দেখি, কোনো কোনো শিক্ষক দলীয় রাজনীতিতে লিপ্ত হয়ে পড়ছেন। এর ফলে, শিক্ষার্থীদের প্রতি তাদের দায়িত্ববোধ ক্রমশ কমে যাচ্ছে। শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করে যে, কিছু শিক্ষক যৌন নিপীড়ন, পরীক্ষায় অনিয়ম এবং পক্ষপাতমূলক আচরণের মাধ্যমে তাঁদের ক্ষতি করছেন। অনেকেই দলীয় পরিচয়ে শিক্ষকতায় এসেছেন, এবং এ কারণে ছাত্র-ছাত্রীদের আস্থা অর্জন করতে ব্যর্থ হন। শিক্ষার্থীরা তাদেরকে শিক্ষক হিসেবে মানতে পারে না। এসব শিক্ষক তাদের কর্তব্যবোধ ভুলে গিয়ে অন্যায় কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হন এবং এতে পুরো শিক্ষাব্যবস্থায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।

অন্যদিকে, শিক্ষকদের মধ্যে যারা নৈতিকতার আদর্শে উজ্জ্বল, তারা ছাত্রদের সঠিক দিশা দেখাতে ব্যস্ত। এক্ষেত্রে প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ আবদুর রাজ্জাকের জীবন থেকে আমরা শিক্ষা নিতে পারি। তিনি শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়াতেন, তাদের অর্থনৈতিক সংকট সমাধানে সহায়তা করতেন এবং এমনকি তাদের বিয়ের ব্যবস্থা পর্যন্ত করতেন। তাঁর মতো শিক্ষকরা শুধু পাঠদান নয়, শিক্ষার্থীদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সহযোগিতা করার চেষ্টা করেছেন। আজকের দিনে এমন শিক্ষকদের প্রয়োজন যাঁরা শুধু জ্ঞান বিতরণকারী নন, বরং সমাজের প্রকৃত গঠনের কারিগর হিসেবে কাজ করবেন।
সরকারের দায়িত্ব শিক্ষকদের আর্থিক ও সামাজিক মর্যাদা নিশ্চিত করা। ন্যায়বান এবং দক্ষ শিক্ষকদের সম্মান দিয়ে তাদেরকে শিক্ষাব্যবস্থায় আরও সক্রিয় ও মনোযোগী করে তোলা প্রয়োজন। পুলিশের গরম পানি ছিটিয়ে আন্দোলনরত শিক্ষকদের ছত্রভঙ্গ করা কোনো সমাধান নয়; বরং তাদের দাবি মেনে নেয়ার মাধ্যমে শিক্ষার উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষকদের প্রতি এমন আচরণ রাষ্ট্রের শিক্ষাব্যবস্থা পুনর্গঠনের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়।

শিক্ষাব্যবস্থায় যে সংকট চলছে তা দূর করতে হলে, শিক্ষকদের আর্থিক নিরাপত্তা, পদোন্নতির সুযোগ এবং তাদের সামাজিক মর্যাদা পুনরুদ্ধার করতে হবে। শিক্ষকদের অভুক্ত রেখে, তাদের ন্যায্য অধিকার না দিয়ে কোনো ধরনের শিক্ষানীতিই কার্যকর করা সম্ভব নয়। রাষ্ট্র যদি প্রকৃত অর্থে শিক্ষাব্যবস্থা উন্নত করতে চায়, তাহলে শিক্ষকদের নৈতিক ও আর্থিক অবস্থার উন্নয়ন নিশ্চিত করা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।
শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নে শিক্ষকদের আর্থিক ও সামাজিক অবস্থার উন্নতির পাশাপাশি তাদের নৈতিক দায়িত্ব পালনের দিকেও বিশেষ মনোযোগ দেওয়া জরুরি। শিক্ষকদের মানসিকতা পরিবর্তন এবং আদর্শ শিক্ষকের চরিত্র গঠন এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। শিক্ষকেরা যদি তাদের নৈতিক দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেন এবং জ্ঞানের প্রকৃত আলো শিক্ষার্থীদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে মনোনিবেশ করেন, তবে শিক্ষার গুণগত মানও উন্নত হবে। শিক্ষার্থীরা শুধু পাঠ্যপুস্তকের জ্ঞান নয়, বরং মানবিকতা, নৈতিকতা এবং সমাজের কল্যাণে কাজ করার অনুপ্রেরণাও লাভ করবে।
তবে শিক্ষকদের নিজেদের স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে শিক্ষার্থীদের মঙ্গল চিন্তা করা জরুরি। শিক্ষকের ভূমিকা কেবল শ্রেণিকক্ষে নয়, বরং সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষকদের উচিত হবে, তারা যেন দলীয় রাজনীতিতে জড়িত না হন এবং ব্যক্তিগত স্বার্থের পরিবর্তে সমাজের বৃহত্তর স্বার্থের দিকে মনোযোগ দেন। শিক্ষার্থীদের মঙ্গল, দেশের ভবিষ্যৎ নির্মাণ এবং শিক্ষার মানোন্নয়নকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে।
শিক্ষাব্যবস্থায় একটি মূল বিষয় হলো শিক্ষকের সঙ্গে শিক্ষার্থীর সম্পর্ক। যুগ যুগ ধরে এই সম্পর্ক শিক্ষার মূল ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। সক্রেটিস, প্লেটো, অ্যারিস্টটলদের মতো প্রাজ্ঞ শিক্ষকেরা তাঁদের শিষ্যদের শুধু পুঁথিগত বিদ্যাই শেখাননি, বরং তাদেরকে জীবনের পথচলার উপযুক্ত পাথেয়ও দিয়েছেন। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায়ও যদি এই আদর্শ শিক্ষকদের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়, তবে দেশের শিক্ষার মানও বহুগুণে বৃদ্ধি পাবে।
সরকারের উচিত শিক্ষকদের আর্থিক নিরাপত্তা এবং পদোন্নতির সুযোগ নিশ্চিত করা। বেসরকারি শিক্ষকদের জন্যও পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। তাদের বেতন, বাড়িভাড়া এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা যেন যথাযথভাবে পূরণ করা হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষকদের পেশাগত জীবনে আর্থিক নিরাপত্তা এবং সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধির পাশাপাশি তাদের পেশাগত সম্মানও রক্ষা করতে হবে। শিক্ষকদের সম্মান অক্ষুণ্ন থাকলে, শিক্ষার্থীরাও তাদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হবে এবং শিক্ষাব্যবস্থা উন্নতির পথে এগিয়ে যাবে।

শিক্ষকদের দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনের পাশাপাশি রাষ্ট্রকেও শিক্ষাব্যবস্থায় আন্তরিক হতে হবে। শিক্ষকদের যথাযথ মর্যাদা এবং আর্থিক সুরক্ষা নিশ্চিত করতে না পারলে, শিক্ষার গুণগত মান কখনোই উন্নত হবে না। একটি সমৃদ্ধশালী জাতি গঠনের জন্য শিক্ষাব্যবস্থার মূল স্তম্ভ হিসেবে শিক্ষকদের যথার্থ ভূমিকা পালন করতে দিতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন সম্মিলিত উদ্যোগ—শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং রাষ্ট্রের একত্রিত প্রচেষ্টা।
এই প্রতিবেদনটির শেষ ধাপে, আমরা শিক্ষাব্যবস্থার সার্বিক উন্নয়ন ও শিক্ষকদের সম্মান রক্ষার জন্য কিছু সুস্পষ্ট প্রস্তাব তুলে ধরব, যেগুলি বাস্তবায়িত হলে বর্তমান সংকট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হতে পারে।
প্রথমত, শিক্ষকদের অর্থনৈতিক মুক্তি জরুরি। বেসরকারি শিক্ষকদের জন্য পর্যাপ্ত এমপিওভুক্তির ব্যবস্থা করতে হবে এবং তাদের বেতন, ভাতা ও সুযোগ-সুবিধা সরকারি শিক্ষকদের সমান করতে হবে। শিক্ষকদের বেতন বৃদ্ধির পাশাপাশি বাড়িভাড়া ও চিকিৎসা ভাতা বাড়ানোর দাবি মেনে নিতে হবে। এটি নিশ্চিত করা দরকার যে, শিক্ষকরা যাতে কেবলমাত্র শিক্ষাদানে মনোনিবেশ করতে পারেন এবং কোনো অর্থনৈতিক চাপ তাদের ওপর না থাকে। এতে শিক্ষার মানও উন্নত হবে এবং শিক্ষকরা মানসিকভাবে আরো স্থিতিশীল থাকবেন।
দ্বিতীয়ত, শিক্ষকদের পদোন্নতি প্রক্রিয়াকে সহজ ও স্বচ্ছ করা উচিত। উচ্চমাধ্যমিকের প্রভাষকদের ক্ষেত্রে সহকারী অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক ও অধ্যাপক পদের পদোন্নতি সহজ করতে হবে, যাতে তারা তাদের কর্মজীবনে ন্যায্য সুযোগ পেতে পারেন। বর্তমান জটিল ও অমানবিক নিয়মাবলী শিক্ষকদের মধ্যে হতাশা সৃষ্টি করছে, যা শিক্ষার মানকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করছে।
তৃতীয়ত, শিক্ষকদের নৈতিকতার মান বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণ এবং মূল্যবোধের শিক্ষা প্রচলন করা উচিত। শিক্ষকরা যেন দলীয় রাজনীতি, অর্থ আত্মসাৎ, ঘুষ, কিংবা দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত না হন, তা নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষকদের প্রতি শিক্ষার্থীদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে শিক্ষকদের নৈতিক দায়িত্ববোধ বাড়াতে হবে।
শেষত, রাষ্ট্রকে শিক্ষাব্যবস্থায় বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। শিক্ষকদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে এবং শিক্ষাব্যবস্থায় আরো সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির জন্য সরকারকে পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ করতে হবে। শিক্ষার মৌলিক উন্নয়নে শিক্ষকের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আর তাই শিক্ষকদের মর্যাদা, সঠিক মূল্যায়ন ও উন্নত আর্থিক সুবিধা নিশ্চিত করার মধ্য দিয়েই শিক্ষার বর্তমান সংকট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।
সব মিলিয়ে, শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন শিক্ষকদের স্বার্থরক্ষার মধ্য দিয়েই আসতে পারে। শিক্ষকদের মর্যাদা ও আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে কোনো শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন সম্ভব নয়। শিক্ষকরা সমাজের মূল চালিকাশক্তি, যারা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে গড়ে তোলেন। তাদের দায়িত্ব, সুযোগ-সুবিধা ও সম্মান সঠিকভাবে নিশ্চিত করা হলে, শিক্ষার উন্নয়ন এবং সমাজের সামগ্রিক অগ্রগতি একসঙ্গে সম্ভব হবে।