জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে সংস্কার প্রস্তাব জমা দিতে গিয়ে ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান নিয়েছে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। ছয়টি বিষয়ের ওপর গঠিত কমিশনের ১৬৬টি সুপারিশ নিয়ে এই তিন দলের অবস্থান এক নয়। দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ, সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনসহ নানা বিষয়ে রয়েছে তাদের দ্বিমত। অন্তর্বর্তী সরকারের সময় সংস্কারের পরিধি নিয়েও মতভেদ রয়েছে।
গত মাসের শুরুতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ছয়টি সংস্কার কমিশনের রিপোর্ট ও ১৬৬টি সুপারিশসহ চিঠি পাঠায় ৩৪টি রাজনৈতিক দলের কাছে।
বিএনপি বলছে অনেক বিষয়ে একমত নয়-
কমিশনের সুপারিশে ১৯৭১ ও ২০২৪ সালকে এক কাতারে আনার বিষয়টি মেনে নেয়নি বিএনপি। রাষ্ট্রের নাম পরিবর্তনের প্রস্তাবেও রাজি হয়নি দলটি। বিচার বিভাগের ক্ষেত্রে বিএনপি বেশিরভাগ প্রস্তাবে একমত। তবে ৩১টি সুপারিশের মধ্যে চার-পাঁচটিতে ভিন্নমত দিয়েছে তারা।
বিএনপি চায়, অধ্যাদেশের মাধ্যমে আইন সংশোধন করে নির্বাচন কমিশনের হাতে সীমা নির্ধারণের ক্ষমতা দেওয়া হোক। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) নিয়ে ২০টি প্রস্তাবের মধ্যে ১১টিতে দলটি একমত। একটি প্রস্তাবে ভিন্নমত দিয়েছে। প্রশাসন সংস্কার নিয়ে ২৬টি প্রস্তাবের মধ্যে প্রায় অর্ধেকেই তারা নিজস্ব মত দিয়েছে।
কমিশনের পাঠানো স্প্রেডশিট অনুযায়ী, বিএনপি ২০টির মধ্যে ১১টি প্রস্তাবে সরাসরি একমত। সাত-আটটি প্রস্তাবে মন্তব্যসহ নীতিগতভাবে একমত। একটি প্রস্তাবে তারা দ্বিমত জানিয়েছে। প্রশাসন সংস্কারের ২৬টি বিষয়ের অর্ধেকের বেশি প্রস্তাবে একমত এবং বাকি প্রস্তাবগুলোতে তাদের নিজস্ব মতামত রয়েছে।
কমিশনের এক সুপারিশে ১৯৭১ ও ২০২৪ সালকে এক কাতারে রাখা হয়েছে। বিএনপি এটিকে গ্রহণযোগ্য মনে করে না। দলটি মনে করে, রাষ্ট্রের নাম পরিবর্তনের দরকার নেই।
নির্বাচনি সংস্কার কমিশনের সুপারিশে বলা হয়েছে, অনেক প্রস্তাব সংবিধান সংশোধনের সঙ্গে জড়িত। বিএনপি বলছে, এসব প্রস্তাব নির্বাচন কমিশনের কাজ নয়। এসব বিষয়ে তাদের মতামত সংবিধান সংস্কার কমিশনের রিপোর্টেই দেওয়া হয়েছে।
গত ৬ মার্চ বিএনপিসহ ৩৭টি রাজনৈতিক দলকে চিঠি ও সুপারিশের তালিকা পাঠায় কমিশন। সংবিধান, নির্বাচনব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, দুর্নীতি দমন ও বিচার বিভাগ নিয়ে তৈরি হয় এই ১৬৬টি প্রস্তাব।
সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন চায় জামায়াত-
জামায়াতে ইসলামী সংবিধানের মূলনীতিতে আল্লাহর প্রতি অবিচল আস্থা ফিরিয়ে আনতে চায়। তারা সংবিধান, জনপ্রশাসন, বিচার বিভাগ, নির্বাচন ও দুর্নীতি দমন কমিশন বিষয়ে কিছু প্রস্তাবে দ্বিমত দিয়েছে।
তাদের মতে, যারা রাজনৈতিকভাবে নিরপেক্ষ নয়, তাদের নির্বাচন কমিশন, রিটার্নিং ও প্রিসাইডিং অফিসার হিসেবে রাখা যাবে না। তারা পিআর বা সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচন চায়।
সংবিধানে সাম্য, গণতন্ত্র, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার বজায় রাখার পক্ষে তারা। দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্টের প্রস্তাবে তারা পুরোপুরি একমত নয়। তবে বিস্তারিত মতামত দিয়েছে।
৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে জামায়াত বলেছে, আস্থাভোট ও বাজেট নিয়ে এই অনুচ্ছেদ কীভাবে কাজ করবে, তা পরিষ্কার করতে হবে। জাতীয় নির্বাচনের আগে গণপরিষদ নির্বাচন চায় না দলটি।
গণপরিষদ চায় এনসিপি-
জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ঐকমত্য কমিশনের ১৬৬টি প্রস্তাবের মধ্যে ১১৩টিতে একমত। ২৯টিতে আংশিক এবং ২২টিতে তারা দ্বিমত জানিয়েছে।
তারা চায়, আসন্ন নির্বাচনটি গণপরিষদ নির্বাচন হিসেবে হোক। প্রার্থী মনোনয়নে ১০ শতাংশ তরুণ-তরুণী থাকতে হবে। সর্বোচ্চ বয়সসীমা ৩৫ বছর হওয়া উচিত বলেও মত দিয়েছে দলটি।
তারা বলেছে, সংসদ সদস্য হওয়ার বয়সসীমা কমিয়ে ২৩ বছর করা দরকার। ডেপুটি স্পিকার একজনই হবেন এবং তিনি হবেন বিরোধী দল থেকে। প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা একই ব্যক্তি হতে পারেন। তবে মন্ত্রিসভায় প্রথমজন হলে আলাদা ব্যবস্থা দরকার নেই।
অর্থবিল ছাড়া অন্য কোনো বিষয়ে দলের বাইরে মত দেওয়া যাবে। দলের বিরুদ্ধে অনাস্থা ভোটের ব্যবস্থা রাখা যেতে পারে।
দলটি দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের পক্ষে। উচ্চকক্ষের প্রার্থী আগে থেকে ঘোষণা করতে হবে। জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল বা এনসিসির প্রতি তাদের সমর্থন রয়েছে। তবে তারা চায়, সিদ্ধান্ত নিতে দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের ভোট লাগবে।
তারা মনে করে, নির্বাচনকালীন একটি অন্তর্বর্তী সরকার থাকা দরকার। এই সরকারের কাজ হবে শুধু নির্বাচন আয়োজন। এর সময়সীমা হতে পারে ৭০ থেকে ৭৫ দিন। তবে যদি ইসি ও এনসিসি থাকে, তাহলে আলাদা তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রয়োজন নেই। এনসিসিই দায়িত্ব নিতে পারবে।
নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়া পর্যন্ত এনসিসি থাকবে। এই সময় তাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ এলে তা তদন্ত করতে পারবে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল। বিচার বিভাগের জন্য আর্থিক স্বাধীনতা এবং স্বতন্ত্র সচিবালয়ের প্রস্তাবও দিয়েছে এনসিপি।

