সরকারকে প্রকৃত ব্যবসায়ীদের পাশে দাঁড়াতে হবে। একই সাথে ব্যবসার নামে টাকা পাচারকারীদের সবোর্চ্চ দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণগ্রহীতা ব্যবসায়ী ও ঋণদাতা ব্যাংক উভয়েরই রক্ষক। উভয়ের পাশেই কেন্দ্রীয় ব্যাংককে দাঁড়াতে হবে। দেশের স্বার্থে, অর্থনীতির স্বার্থে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংককে প্রকৃত ব্যবসায়ীদের রক্ষা করতে হবে।
এ লেখা প্রকৃত ব্যবসায়ীদের নিয়ে। দেশের টাকা লুটপাট করা ব্যবসায়ীদের নিয়ে নয়। বাংলাদেশে খুবই জনপ্রিয় ও প্রচলিত ধারনা হচ্ছে ব্যবসায়ীরা ব্যবসার নামে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে তা বিদেশে পাচার করেন। দেশে-বিদেশে বাড়ি, গাড়ি, সম্পদ কিনে ভোগ বিলাসিতা করে জীবন কাটিয়ে দেন। ব্যাংকের টাকা আর ফেরৎ দেন না। এই ধারনা একেবারেই অনর্থক নয়। বাস্তবিকভাবে কোন কোন ব্যবসায়ী এটা করেন, কেউ কেউ এর চেয়েও অনেক ভয়ানক আর্থিক অপরাধ করেন। কিন্তু সেইসব ব্যবসায়ীদের সংখ্যা দেশের সমগ্র ব্যবসায়ীদের সংখ্যার অনুপাতে খুবই কম। ধারনা করা হয়, এই ধরনের অপরাধের সাথে জড়িত ব্যবসায়ীর সংখ্যা শতকরা ১—৫ শতাংশ। এদেশের সিংহভাগ ব্যবসায়ীই ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে প্রকৃত অর্থে ব্যবসা করেন। নিজের ও পরিবারের সদস্যদের জীবন বাজি রেখে কলকারখানা গড়ে তোলেন, শ্রমবাজার ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেন এবং ব্যাংককে মুনাফা দেন। সরকারকেও বড় অংকের রাজস্ব প্রদান করেন। এই ৯৫ শতাংশ ব্যবসায়ীর ত্যাগ, তিতিক্ষা আর অবদানেই বাংলাদেশ আজ কৃষিভিত্তিক দেশ থেকে শিল্পভিত্তিক দেশে পরিণত হয়েছে। রয়েছে মধ্যম আয়ের দেশ হওয়ার দ্বারপ্রান্তে।
বাংলাদেশে এ ধারনাও সুপ্রতিষ্ঠিত যে, বিনিয়ম ছাড়া সৎপথে সাধারণত কেউ অনেক ব্যাংক থেকে ঋণ পান না। ব্যবসার জন্য ঋণ পেতে অনেক ব্যাংকের মালিকপক্ষ এবং ব্যবস্থাপনা কতৃর্পক্ষকে অবশ্যই খুশি করতে হয়। এদেশে ক্ষুদ্র ও মাঝারি আকারের ব্যাংক ঋণ পাওয়া যতটা কঠিন, বড় অংকের ঋণ পাওয়া ঠিক ততটাই সহজ। জনশ্রুতি আছে এদেশে ব্যবসার জন্য ১—২ কোটি টাকা ঋণ পাওয়ার চেয়ে ১০০—২০০ কোটি টাকা ঋণ পাওয়া তুলনামূলক সহজ। কানাডার বেগমপাড়া, আমেরিকা, ইউরোপ বা সিঙ্গাপুরে কিছু ব্যবসায়ীর সাথে কিছু ব্যাংকারও আয়েশী জীবন যাপন করেন। ব্যাংক খাতের প্রকাশিত নানা কেলেঙ্কারির ঘটনায় এটা বারবার সুপ্রমাণিতও হয়েছে। এখানেও ব্যাংকের মালিকপক্ষ ও উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে হয়তো সবোর্চ্চ ৫ শতাংশ ব্যাংকার এই ভয়ংকর অপরাধে জড়িত। তাই বাকি ৯৫ শতাংশ ব্যাংকারকে ঢালাওভাবে দোষারোপ করা যাবে না। সিংহভাগ ব্যাংকারকেই সকাল থেকে রাত অবধি অক্লান্ত পরিশ্রম করতে হয়। অধিকাংশ ব্যাংকারকেই মাল্টিরোল যুদ্ধবিমানের মত আমানত সংগ্রহ, ঋণ প্রদান, ঋণ আদায়, প্রকল্প পরিদর্শন ইত্যাদি নানামুখী ভূমিকা পালন করতে হয় ক্লান্তিহীনভাবে। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় দেখেছি অনেক ব্যাংকারকে গভীর রাত অবধি আইনজীবীর চেম্বারে কাজ করে আবার সকালে নিয়মিত অফিস করতে হয়। বছরের পর বছর হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে সেই অফিসারকেই ডাম্প পোস্টিং দেয়া হয় অবহেলিত কোন পদে।
লেখার মূল প্রসঙ্গে ফেরা যাক। দুঃখজনক হল এদেশের কত শতাংশ ব্যবসায়ী ইচ্ছাকৃত খেলাপী, আর কত শতাংশ ব্যবসায়ী ব্যাংক ও অন্যদের কারনে বাধ্য হয়ে খেলাপী হয়েছেন, তার নূন্যমত কোন পরিসংখ্যান নেই। আজ অবধি এ সংক্রান্ত কোন নীতিমালাও নেই। তাই স্রোতে গা ভাসিয়ে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ বহিভূর্ত কারনে বিপদে পড়া সব ব্যবসায়ীকেই বাছবিচারহীনভাবে খেলাপি বা ইচ্ছাকৃত খেলাপি বলা হচ্ছে। গণহারে সবাইকে খেলাপী বা ইচ্ছাকৃত খেলাপী তকমা দিয়ে আইন, বিধি, সাকুর্লার জারি হচ্ছে নিয়মিত। অথার্ৎ কেউ ঋণ খেলাপি হলেই তাকে প্রায় ফাঁসিই দিচ্ছি কিন্তু তার খেলাপী হওয়ার ধরন, কারণ, উৎস বা আসল দায় খুঁজতে সবাই নারাজ। আর খেলাপি ঋণের মূল সমস্যা এখানেই।
২০২৩ সালে ব্যাংক কোম্পানী আইন সংশোধন করে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপী শনাক্ত, চিহ্নিত করা ও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার বিধান করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকও এ সংক্রান্ত বিআরপিডি সার্কুলার ৬ জারি করেছে ১২ মার্চ, ২০২৪। উক্ত আইন ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাকুর্লার অনুযায়ী ঋণদাতা ব্যাংক কোন ঋণ গ্রহীতাকে ইচ্ছাকৃত খেলাপী ঋণগ্রহীতা হিসেবে শনাক্ত করবেন যদি তারা:
১। কোনো ব্যাংক—কোম্পানী বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান হতে গৃহীত ঋণ, অগ্রিম, বিনিয়োগ বা অন্য কোন আর্থিক সুবিধা বা এর অংশ বা এর উপর আরোপিত সুদ বা মুনাফা তার সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও পরিশোধ না করে;
২। জালিয়াতি, প্রতারণা বা মিথ্যা তথ্য প্রদানের মাধ্যমে নিজের, তার পরিবারের সদস্যের, স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানীর নামে ঋণ, অগ্রিম, বিনিয়োগ বা অন্য কোন আর্থিক সুবিধা গ্রহণ করে;
৩। যে উদ্দেশ্যে ঋণ, অগ্রিম, বিনিয়োগ বা অন্য কোন আর্থিক সুবিধা গ্রহণ করেছিলেন সে উদ্দেশ্য ব্যতীত অন্য কোন উদ্দেশ্যে উক্ত ঋণ, অগ্রিম, বিনিয়োগ বা আর্থিক সুবিধা বা এর অংশ ব্যবহার করেছে;
৪। প্রদত্ত জামানত ঋণ বা অগ্রিম প্রদানকারী কোন ব্যাংক-কোম্পানী বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের লিখিত পূর্বানুমতি ব্যতীত হস্তান্তর বা স্থানান্তর করে। এরুপ ক্ষেত্রে ঋণদাতা ব্যাংক উক্ত ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণগ্রহীতাকে শনাক্ত করার পর তা বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠাবেন। এরপর বাংলাদেশ ব্যাংকের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত হবে।
এভাবে কোন ঋণ গ্রহীতা যদি ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপী হিসেবে শনাক্ত ও চূড়ান্ত হন, তাহলে তার বিদেশ যাত্রায় নিষেধাজ্ঞা, ট্রেড লাইসেন্স ইস্যু ও নবায়ন নিষেধাজ্ঞা, সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সেঞ্জ কমিশন ও আরজেএসসি তে কোম্পানি নিবন্ধন- এর উপর নিষেধাজ্ঞা থাকবে। তিনি কোন রাষ্ট্রীয় পুরস্কার ও সম্মাননা পাবেন না। তার বাড়ি, গাড়ি, জমি, ফ্ল্যাট ইত্যাদির নিবন্ধনেও বাধা প্রদান করা হবে। তিনি কোন ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক হতে পারবেন না। তাকে ২ মাসের মধ্যে সুদসহ ঋণের সমস্ত টাকা পরিশোধ করতে হবে। তার বিরুদ্ধে যে কোন ফৌজদারী, অর্থঋণ, চেকের মামলা করা যাবে। তার আরোপিত, অনারোপিত কোন সুদ মওকুফ করা যাবে না। তার কোন ঋণ পুনঃতফসিল করা যাবে না। তার ঋণ অন্য কোন ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান টেকওভার করতে পারবে না। তিনি সকল প্রকার সুদ সহ ঋণের সকল অর্থ পরিশোধ না করা পর্যন্ত খেলাপী ঋণ গ্রহীতা হিসেবে বিবেচিত হবেন।
প্রকৃত ইচ্ছাকৃত খেলাপীদের বিরুদ্ধে এসব পদক্ষেপ আমাদের আশান্বিত করে। কিন্তু কিছু যৌক্তিক কারণে একই সাথে উদ্বেগও জাগায়। এই আইন ও সাকুর্লারে ইচ্ছাকৃত ও অনিচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপীর কোন পার্থক্য করা হয়নি। যেসব ব্যবসায়ী ব্যাংকের কারণেই বাধ্য হয়ে খেলাপী হন, তাদের জন্য এখানে কিছুই বলা হয়নি। এখানে ঋণ পরিশোধে অক্ষম সব ব্যবসায়ীকে এক কাতারে দাঁড় করানো হয়েছে। ঋণ পরিশোধে ব্যর্থতার কারণ ও প্রকৃত দায় খোঁজা হয়নি। ৫ শতাংশ ব্যবসায়ীর অপরাধের জন্য বাকি ৯৫ শতাংশ ব্যবসায়ীকে জঘণ্য অপরাধের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়েছে।
এ সাকুর্লারের মাধ্যমে ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপীদের শাস্তি দিয়ে ব্যাংক কোম্পানির মূলধন, আয়, মুনাফা, তারল্য বাড়িয়ে সামগ্রিক অর্থনৈতিক কর্মকান্ডকে আরো গতিশীল করার কথা বলা হয়েছে। অথচ এই সাকুর্লারের কোথাও ব্যবসায়ীদের দুরাবস্থা, হয়রানি, নাজেহাল, ভোগান্তির বিষয়ে কিছুই বলা হয়নি। সাকুর্লার পড়লে মনে হবে যে, ঋণ পরিশোধে অক্ষম দেশের শতভাগ ব্যবসায়ীই ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপি। সাকুর্লারের উদ্দেশ্য দেখলে মনে হবে যে শুধুমাত্র ব্যাংকের মূলধন, আয়, মুনাফা দিয়েই দেশের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড গতিশীল হয়। সেখানে ব্যবসা বা ব্যবসায়ীদের কোন অবদান নেই। মনে হবে একমাত্র ব্যাংকের আয় বৃদ্ধির মাধ্যমেই বাংলাদেশকে কৃষিভিত্তিক দেশ থেকে শিল্পভিত্তিক দেশে রূপান্তরিত করে, এখন মধ্যম আয়ের দেশের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা সেখানে শুধুই দর্শক ও সুবিধাভোগী।
এ সার্কুলারে কোন ব্যবসায়ীকে ইচ্ছাকৃত খেলাপী ঋণ গ্রহীতা হিসেবে চিহ্নিত করতে ঋণদাতা ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে অনিয়ন্ত্রিত, অস্বচ্ছ ও জবাবদিহিতাহীন ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। ঋণগ্রহীতার দুরাবস্থা, ক্ষতি, ভোগান্তি, পূর্বের ঋণ পরিশোধের রেকর্ড সবকিছুই অবজ্ঞা করার অবারিত ক্ষমতা দেয়া হয়েছে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে। এমনকি ঋণগ্রহীতা যদি ঋণদাতা ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কোন কর্মকান্ডের কারণেই অনিচ্ছাকৃতভাবেও ঋণখেলাপী হন তারপরেও তিনি ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপী হবেন। ব্যবসায়ীর দুরাবস্থার জন্য দায়ী ব্যাংকই তাকে ইচ্ছাকৃত খেলাপী হিসেবে চিহ্নিত করতে পারবে। যা পুরোপুরি অসম, অন্যায্য ও অবিচার। এ সাকুর্লারে ইচ্ছাকৃত খেলাপী ঋণ গ্রহীতার সংজ্ঞায় শর্ত হিসেবে উল্লেখিত “সে উদ্দেশ্য ব্যতীত অন্য কোন উদ্দেশ্যে”, “সামর্থ্য থাকা স্বত্বেও”, “প্রতারণা” বিষয়সমূহের ব্যাখ্যা করা হয়নি। এগুলোর ধারণা ও ব্যাখ্যা সুষ্পষ্ট না করে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার পুরো ক্ষমতা খুবই অযৌক্তিক ও অগ্রহণযোগ্যভাবে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের হাতে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। এতে অনেক নিরপরাধ ও প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী ইতোমধ্যেই অনেক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান দ্বারা নিগ্রহের শিকার হয়েছেন এবং নিয়মিত হচ্ছেন।
সার্কুলারে বলা হয়েছে ইচ্ছাকৃত খেলাপী ঋণ পুনঃতফসিল করা যাবে না। অথচ বিবেচনাই করা হয়নি যে, ঋণ পুনঃতফসিল, পুনঃগঠন করতেও সুদসহ মোট খেলাপি ঋণের একটা বড় অংশ ডাউনপেমেন্ট হিসেবে প্রদান করতে হয়। অনেক সময় এ টাকা জোগাড় করতেই ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীর দম বন্ধ হয়ে যায়। আবার রিসিডিউল (পুন:তফসিল) করলে সমস্ত সুদ আসল হয়ে যায়, তার উপর নতুন করে কয়েক ধাপে সুদ আরোপ হয়। এরপরও ঋণ পুন:তফসিল বা পুন:গঠন না হলে প্রকৃত ব্যবসায়ীরা কিভাবে ব্যবসা এবং কারখানা চালু রাখবেন? কিভাবে মূলধন পাবেন, শ্রমিকের বেতন দিবেন, পণ্য উৎপাদন, রপ্তানি করবেন, কাঁচামাল আমাদানি করবেন? অনেকটা নীতিমালার নামে প্রকৃত ব্যবসায়ীদের নীতিমালার যাঁতাকলে পিষে মেরে ফেলার মত অবস্থা। যার জন্য কারো কোন দায় নেই বা থাকবেও না। নীতিমালার নামে সবই বৈধ। আবার ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে মাত্র ২ মাস সময় দেয়া হয়েছে সুদ-আসলসহ পুরো ঋণ পরিশোধের জন্য। কিভাবে একজন ক্ষুদ্র, মাঝারি বা বড় ব্যবসায়ী মাত্র ২ মাসের মধ্যে তার সব ধরণের সুদ-আসলসহ পুরো ঋণ শোধ করবেন, তা বোধগম্য নয়।
উক্ত সাকুর্লারে ক্ষুদ্র, মাঝারি, বড় যে কোন ব্যবসায়ীকেই ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইচ্ছাকৃত খেলাপী হিসেবে চিহ্নিত করে, তাকে উল্লেখিত কঠোর শাস্তি দিতে পারবে। তার ঋণ ১০ লাখও হতে পারে বা ১০০ কোটিও হতে পারে। এ ধরণের বিধান খুবই হতাশাজনক । দেশের অর্থনীতিতে এর ভয়াবহ প্রভাব সহজেই অনুমেয়। এ সার্কুলারে দেশে বিদ্যমান অর্থনীতি, ব্যবসা, বাণিজ্যের কোন অবস্থাই আসলে বিবেচনায় নেয়া হয়নি। ঋণ খেলাপীর নামে বিদ্যমান সকল রুঢ় বাস্তবতাকে আগ্রাহ্য করে স্রোতে গা ভাসানো হয়েছে। আবার উক্ত সাকুর্লারে কোথাও বলা হয়নি যে, কোন ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান কোন অসৎ উদ্দেশ্যে ও হয়রানি করার নিমিত্তে কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপী হিসেবে চিহ্নিত করবে না। যদি চিহ্নিত করে তাহলে সে ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের শাস্তি কি হবে তাও বলা হয়নি। এ সাকুর্লারে ধরেই নেয়া হয়েছে যে, একমাত্র ব্যবসায়ীরাই সব অপরাধ করেন এবং তারাই শাস্তি পাবেন। কোন ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান কখনো কোন অন্যায় করেন না। (Banks and Financial Institutions never do any wrong).
এই সাকুর্লার বা অন্য কোথাও আজ অবধি বলা হয়নি যে, যদি প্রকৃত ঋণগ্রহীতা ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কোন ব্যাংকের কারণে বা অন্য কোন কতৃর্পক্ষের দায়ে বা সরকারের কোন ভুল নীতির কারণে বা নিয়ন্ত্রণ বর্হিভূত অন্য কোন কারণে ইচ্ছার বিরুদ্ধে খেলাপী হয়, তাহলে সেই ঋণগ্রহীতার প্রতিকার কী। ভাল ব্যবসায়িকে কৌশলে খেলাপি বানানো হলে দায়ীদের বিরূদ্ধে সুস্পষ্ট আইনি বা অন্য কোন যথাযথ প্রতিকার এখনো এদেশে নেই। একজন ব্যবসায়ীকে শাস্তি প্রদানের জন্য অসংখ্য আইন আছে কিন্তু ব্যবসায়ীকে বহুমুখী হয়রানি থেকে সুরক্ষার জন্য কোন কতৃর্পক্ষ বা যথাযথ আইন নেই। এই সাকুর্লার মূলত ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ও ব্যাংকের পক্ষে একটি One way traffic এর মত। কোন ঋণগ্রহীতাকে ইচ্ছাকৃত খেলাপী হিসেবে চিহ্নিত করা হলে এ সাকুর্লার অনুসারে তার যেসব শাস্তির বিধান করা হয়েছে তাতে তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও নিজের মৃত্যুঘন্টা দ্রুত বেজে উঠবে বলা যায়। এত বড় শাস্তির বিপরীতে ব্যবসায়ী ঋণগ্রহীতাকে নিজের অনিচ্ছাকৃত দুরাবস্থার কথা বলার বা প্রতিকার পাবার যথাযথ কোন ব্যবস্থা এখানে নেয়া হয়নি। এ সাকুর্লারে ব্যবসায়ী সমাজ, দেশের অর্থনীতি, ব্যবসা, বাণিজ্য সবকিছুকে উপেক্ষা করে শুধু একপাক্ষিকভাবে ব্যাংকের ট্রেডিং স্বার্থ রক্ষা করা হয়েছে। একথা এখন প্রায় সুপ্রতিষ্ঠিত যে এদেশে ব্যাংকিং এখন আর সেবা নেই বরং তা অনেকটা ট্রেডিং ব্যবসা হয়ে গেছে। আজ পর্যন্ত এদেশে কোন সমীক্ষা হয়নি কিভাবে অনেক ব্যাংক (এমনকি করোনার মধ্যেও) বিপুল অংকের টাকা প্রতিবছর লাভ করে আর এর বিপরীতে বিপুল সংখ্যক ক্ষুদ্র, মাঝারি ও বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায় এবং দেশের অর্থনীতি সঙ্কুচিত হয়ে পড়ে। সম্প্রতি দেশে প্রায় প্রতিদিন অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠান বন্ধ হচ্ছে, শ্রমিকেরা কাজ হারাচ্ছে আর তার বিপরীতে কিছু ব্যাংক ২০০০ কোটি টাকা পরিচালনা মুনাফার এলিট ক্লাবে ঢুকছে। এ যেন এক দেশে দুই অর্থনীতির মতো আরেক প্রকট বৈষম্য। প্রশ্ন জাগে শিল্প এবং ব্যবসা বন্ধ করে এই উন্নয়ন কতক্ষণ টিকে থাকবে?
এ সাকুর্লারে ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপী শনাক্ত ও চূড়ান্ত করণের পুরো প্রক্রিয়ায় ব্যপক অস্বচ্ছতা রয়েছে। এটি সাম্য ও ন্যায়বিচারের ধারনার সম্পূর্ণ বিপরীত এবং একপাক্ষিক একটি সাকুর্লার। এ সাকুর্লারে ব্যাংক ও ঋণগ্রহীতা ব্যবসায়ী উভয়ের ক্ষেত্রেই স্বচ্ছতা, ন্যায্যতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা অত্যাবশ্যক ছিল। সব ব্যবসায়ীকে ঢালাওভাবে আসামী বা অপরাধীর কাঠগড়ায় দাঁড় করানো চূড়ান্তভাবে দেশের অর্থনীতির জন্যই আত্মঘাতী হবে।
একজন প্রকৃত ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, রপ্তানীকারক একদিনে বা হঠাৎ করে তৈরি হন না। একজন প্রকৃত ব্যবসায়ীকে ২৪ ঘন্টাই কাজ করতে হয়। বাংলাদেশের মতো দেশে উদ্যোক্তা হওয়া কত কঠিন তা ভূক্তভোগী ছাড়া কেউ জানে না। উদ্যোক্তাদের এখানে পদে পদে অন্তহীন বাধা। আছে গভীর আমলাতান্ত্রিক জটিলতা। ব্যাংক ঋণ পাওয়া, কারখানা নির্মাণ, যন্ত্রপাতি আমদানি ও স্থাপন, সকল প্রকার ডকুমেন্টেশন, পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস সংযোগ পাওয়া, কার্যাদেশ পাওয়া, উৎপাদন, কাঁচামাল সংগ্রহ, শ্রমিক ব্যবস্থাপনা, শিপমেন্ট, রপ্তানি পণ্য পৌঁছানো, রপ্তানির টাকা আদায় এসব কতটা কঠিন আর চ্যালেঞ্জের তা একজন উদ্যোক্তা ছাড়া কেউ জানেনা। এরপর আছে ব্যাংকের সুদ, আসল, চার্জ পরিশোধ। আরো আছে চাঁদাবাজি, জ্বালানি সংকট, অবকাঠামোগত প্রতিকূলতা, সরকারি প্রতিষ্ঠানের অদক্ষতা, অবহেলা, বৈদেশিক মুদ্রার অগ্রিম আয়কর, দেশে ও বিদেশে অস্থিতিশীল অবস্থা, ঘুষ, দুনীর্তি, শ্রমিক অসন্তোষ। নিজের মূলধন, পর্যাপ্ত জামানত না থাকলে কোন ব্যাংক হয়ত কোন ব্যবসায়ীর সাথে আগ্রহ নিয়ে কথাও বলবে না। কোন কোন ব্যাংকের মালিকপক্ষ বা উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে যাদের সংযোগ আছে তারা আবার সবকিছুর উর্ধ্বে। তারা জামানত ছাড়াই একাউন্ট খুলে ঋণ পায়। ঋণ পেতে ব্যাংকিং নিয়ম কানুনের কোন কিছুই এরা তোয়াক্কা করে না। ব্যাংকের টপ ম্যানেজমেন্টের যোগসাজশে এরা সবকিছুর উর্ধ্বে। ব্যবসায়ী ও ব্যাংকার দুই দিক থেকেই এরা উল্লেখিত “৫ শতাংশ”।
প্রকৃত ব্যবসায়ীরা উল্লেখিত সমস্ত প্রতিবন্ধকতা মাথায় নিয়েই ক্লান্তিহীন পরিশ্রম করে দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষের কর্মসংস্থান করেন, বেকারত্ব দূর করেন, দেশে বৈদেশিক মুদ্রা আনেন। দেশে নানামুখী শিল্প গড়তে নেতৃত্ব দেন। আবার ব্যাংকেও মুনাফা দেন। অনেক প্রকৃত ব্যবসায়ী নিজের শারীরিক জটিল সমস্যা নিয়েও শিল্পকারখানা চালু রাখেন, শ্রমিকদের নিয়মিত বেতন দেন, সরকারকে রাজস্ব দেন। নানামূখী বাধা টপকে পণ্য উৎপাদন করে বিদেশে রপ্তানি করে দেশের অর্থনীতি সমৃদ্ধ করেন।
দেশীয়, আন্তর্জাতিক অস্থিরতা ও প্রতিযোগিতা, কাঁচামালের দুষ্প্রাপ্যতা, সময়মত ব্যাংক থেকে মূলধন না পাওয়া, আমদানি, রপ্তানিতে সীমাহীন হয়রানি, সরকারি ভুলনীতি, ব্যাংকের অসহযোগিতা, সুদের উপর সুদ, উচ্চ হারের ডাউনপেমেন্ট এই সবকিছু মাথায় নিয়েই এদেশে প্রকৃত ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করেন। এরা চাইলেই এইসব কিছু বাদ দিয়ে বিদেশে গিয়ে শান্তি ও সুখের জীবন যাপন করতে পারেন। প্রশ্ন হচ্ছে এত প্রতিকূলতার পরে একজন ব্যবসায়ী তাঁর উৎপাদিত পণ্য থেকে আসলে কত শতাংশ মুনাফা করেন? ১০ শতাংশ মুনাফা করাও এখন অনেক কঠিন হয়ে গেছে। এরপরেও যে টাকা তারা ব্যাংকে পরিশোধ করেন ব্যাংক সেটা দিয়ে আগে সুদ সমন্বয় করে। এতে ব্যাংক শতভাগ লাভবান হলেও ব্যবসায়ীরা একসময় খেলাপী হতে বাধ্য হন। ব্যবসায়ীদের এই দুরাবস্থায় অনেক ব্যাংক প্রকৃত অর্থে পাশে না দাঁড়িয়ে উচ্চহারে ডাউনপেমেন্ট নিয়ে ঋণ পুনঃতফসিলের জন্য নানামুখী চাপ তৈরি করে। একসময় বাধ্য হয়ে ব্যবসায়ীরা ঋণ পুনঃতফসিল করেন। এতে ব্যাংক লাভবান হলেও ব্যবসায়ীর পতন আরো ত্বরান্বিত হয়। ফলত কিছুদিন পর কারখানা বন্ধ হয়, শ্রমিক ছাঁটাই হয়, আর উদ্যোক্তা পথে বসেন। কেউ কেউ দেশ ছেড়ে পালান কোন উপায় না পেয়ে। উদ্যোক্তার জামানতের সম্পত্তি, বাড়ি, কারখানা, যন্ত্রপাতি নিলামে উঠে ঋণ খেলাপী তকমা নিয়ে। কেউ কেউ এই সুযোগে ব্যাংকের কারো কারো সাথে যোগসাজশে পানির দরে নিলামে সম্পত্তি কিনে নেন। এই দুষ্টচক্রেই বর্তমানে দেশের বেশিরভাগ ব্যবসা—বাণিজ্য ঘুরপাক খাচ্ছে।
সরকারকে প্রকৃত ব্যবসায়ীদের পাশে দাঁড়াতে হবে। একই সাথে ব্যবসার নামে টাকা পাচারকারীদের সবোর্চ্চ দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণগ্রহীতা ব্যবসায়ী ও ঋণদাতা ব্যাংক উভয়েরই রক্ষক। উভয়ের পাশেই কেন্দ্রীয় ব্যাংককে দাঁড়াতে হবে। দেশের স্বার্থে, অর্থনীতির স্বার্থে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংককে প্রকৃত ব্যবসায়ীদের রক্ষা করতে হবে। শুধু ব্যাংককে আগলে রেখে ব্যবসায়ীদের দূরে ঠেলে দিলে, তা হবে দেশের অর্থনীতির জন্য আত্মঘাতী। নিরপেক্ষ উত্তর খুঁজতে হবে কেন একজন প্রকৃত ব্যবসায়ী ঋণ খেলাপী হন। কেন তিনি সব ছেড়ে বিদেশে চলে যান বা পালিয়ে যান? এখানে কে দায়ী? ব্যাংক, ব্যবসায়ী নাকি অন্য কেউ? দেশের অর্থনীতির স্বার্থে নিমোর্হভাবে এর দায় নিরুপণ করতে হবে। প্রকৃত দায়ীদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। সব ব্যবসায়ীকে বাছবিচারহীনভাবে ঋণ খেলাপী তকমা দেয়ার সংস্কৃতি থেকে অবিলম্বে বের হয়ে আসতে হবে।
খুনের মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তিকেও আত্মপক্ষ সমর্থনের যথেষ্ট সুযোগ দেয়া হয়। অথচ ব্যবসায়ীদের বাছবিচারহীনভাবে খেলাপি বলে একতরফা শাস্তি দিয়ে তাদেরকে দেশে ও সমাজের কাছে ঘৃণ্য মানুষ হিসেবে তুলে ধরা হয়। ব্যাংকের মামলায় অসংখ্য ব্যবসায়ী কঠোর শাস্তি ভোগ করেছেন। কিন্তু প্রকৃত ভুক্তভোগী কোন ব্যবসায়ীর অভিযোগ বা মামলায় কোন ব্যাংকার বা দায়ী অন্য কেউ কোন শাস্তি পেয়েছেন বা ক্ষতিপূরণ দিয়েছেন, এমন নজির বিরল। মনে হচ্ছে, এদেশে ব্যবসা করা অন্যায় আর ব্যাংক ব্যবসা শতভাগ পূণ্যের। যদিও পত্রিকায় প্রকাশিত বিভিন্ন সংবাদ, প্রতিবেদন, বাংলাদেশ ব্যাংকের নানা সার্কুলার বা বিভিন্ন ঘটনা প্রমাণ করে যে অনেক ব্যাংকই নানা অপরাধে যুক্ত।
সিপিডির গবেষণামতে, ব্যবসার পরিবেশে বাংলাদেশ তার এশীয় অঞ্চলের প্রতিযোগী দেশ ভারত, ইন্দোনেশীয়া, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম থেকে অনেক পিছিয়ে। এমনকি দক্ষিণ এশিয়ার দেশ ভারত, নেপাল, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার সঙ্গে তুলনায় বাংলাদেশের স্কোর সর্বনিম্ন। বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ সমীক্ষা প্রতিবেদন মতে আন্তজার্তিক বাণিজ্যে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ সারিতে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের স্কোর ১০০ এর মধ্যে ৫৩.৮৬। এই করুন বাস্তবতায় প্রকৃত ব্যবসায়ীদের দূরে ঠেলে না দিয়ে তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে। ২০২৩ সালে বাংলাদেশে বিদেশী বিনিয়োগ এসেছে মাত্র ৩ বিলিয়ন ডলার। ২০২৪ সালে ৬ মাসে বাংলাদেশে এফডিআই এসেছে মাত্র ১ বিলিয়ন ডলার। অথচ গত ৮ মাসে ভিয়েতনাম বিদেশী বিনিয়োগ পেয়েছে ১৪ বিলিয়ন ডলার। দেশের ব্যবসায়ীরা দেশে বিনিয়োগ না করলে, ব্যবসার সম্প্রসারণ না করলে বিদেশী বিনিয়োগও আসবে না। তাই দেশের প্রকৃত ব্যবসায়ীদের আস্থায় নিতে হবে। তাদের জন্য ব্যবসা সহজ করতে হবে। ব্যাংক ও ব্যবসায়ী উভয়ের ৫ শতাংশ লুটেরাদের শাস্তি দিতেই হবে আর ৯৫ শতাংশকে অবশ্যই রক্ষা করতে হবে। সব ব্যবসায়ীকে জবাবদিহিতাহীনভাবে ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপি তকমা দেয়া দেশের অর্থনীতির জন্য আত্মঘাতী। দেশের অর্থনীতির প্রকৃত কল্যাণে ঋণদাতা ও ঋণ গ্রহীতা উভয়ের জন্য স্বচ্ছতা, ন্যায্যতা আর সুবিচার নিশ্চিত করা খুবই জরুরী।
লেখক— আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট
হেড অব চেম্বারস, ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট ল’ হাউজ
০১৭১৮-০৬৭৪৯৮, palash.lilak@gmail.com