মিয়ানমারের সামরিক জান্তা সরকার বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের মধ্যে ১ লাখ ৮০ হাজার জনকে ফিরিয়ে নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এই ঘোষণা সম্প্রতি থাইল্যান্ডের ব্যাংককে বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলনে হয়। সেখানে মিয়ানমারের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইউ থান শিউ এবং বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টার উচ্চপ্রতিনিধি ড. খলিলুর রহমান বৈঠক করেন। মিয়ানমারের এই সিদ্ধান্তকে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার ইতিবাচক হিসেবে দেখছে। অনেকেই এটিকে দীর্ঘস্থায়ী রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে একটি বড় পদক্ষেপ হিসেবে মূল্যায়ন করছেন।
তবে বাস্তবতা আরও জটিল। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের বেশিরভাগ এলাকা এখন আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে। এই বাহিনী রাজ্যের ১৭টি শহরের ১৪টি দখল করেছে। রোহিঙ্গারা যেখানে বসবাস করতো, সেই এলাকায়ও এখন আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণ। তাই এই বাহিনীর উপস্থিতি এড়িয়ে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়া এখন অসম্ভব হয়ে পড়েছে। ফলে, মিয়ানমার সরকার চাইলেও তাদের নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন সম্ভব নয়।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, মিয়ানমার সরকার কৌশলগত কারণে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে আগ্রহ দেখাচ্ছে। আরাকান আর্মির কাছ থেকে এলাকা হারানোর পর তারা বাংলাদেশকে পাশে পাওয়ার চেষ্টা করছে। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে চীন এবং ভারতসহ আরও অনেক দেশের স্বার্থ রয়েছে। বিশেষ করে, বঙ্গোপসাগরের কাছে থাকা এই অঞ্চলের গুরুত্ব আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে অনেক বেশি। তাই বাংলাদেশকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ইস্যুতে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সব পক্ষের অবস্থান ভালোভাবে বুঝতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক এম শহীদুজ্জামান বলেন, মিয়ানমার এর আগেও রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু বাস্তবে তা কখনোই কার্যকর হয়নি। রোহিঙ্গাদের যেখানে ফিরিয়ে নেওয়ার কথা, সেখানে এখন আরাকান আর্মির দখল। তাদের যাওয়া বা ফিরে আসা কোনোভাবেই সম্ভব নয় যতদিন পর্যন্ত না ওই এলাকায় শান্তি ফিরছে।
ড. খলিলুর রহমান সংবাদ সম্মেলনে বলেন, রাখাইনে শান্তি প্রতিষ্ঠা না হলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সম্ভব নয়। তিনি জানান, বাংলাদেশের সরকার আন্তর্জাতিক সংস্থা ও বিভিন্ন দেশের সঙ্গে মিলে রাখাইন রাজ্যে শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য কাজ করছে। তারা চাইছে, সেখানে মানবিক সংকট দূর হোক এবং যুদ্ধাবস্থা বন্ধ হোক।
তিনি আরও বলেন, প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় অনেক দিক বিবেচনা করতে হবে। রোহিঙ্গারা কোথায় যাবে, সেখানকার নিরাপত্তা কি থাকবে, তাদের জন্য জীবিকা আছে কি না—এইসব বিষয় খতিয়ে দেখতে হবে। এজন্য মিয়ানমারের সঙ্গে যাচাই-বাছাইয়ের কাজ চলছে। একইসঙ্গে আরাকান আর্মির সঙ্গেও আলোচনা চলছে। তারা স্পষ্টভাবে জানিয়েছে, রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়া তাদের নীতিগত অবস্থান। তবে, এটা একদিনে হবে না। ধীরে ধীরে এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে। মিয়ানমার, আরাকান আর্মি, জাতিসংঘ এবং বাংলাদেশের বন্ধুপ্রতিম দেশগুলোকে নিয়ে এই কাজটি সমন্বিতভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে।
ড. খলিলুর রহমান আরও বলেন, আগামী ঈদে রোহিঙ্গারা যেন তাদের দেশে ফিরে উৎসব করতে পারে, সেটাই তাদের লক্ষ্য। এই লক্ষ্যে বাংলাদেশ কাজ করছে এবং সব পক্ষের সহযোগিতা নেওয়া হচ্ছে।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ঘোষণা আশার আলো দেখালেও বাস্তবে এটি এখনো অনেক দূরের পথ। মিয়ানমারের সামরিক জান্তার কৌশল এবং আরাকান আর্মির প্রতিরোধ অনেক বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে, বাংলাদেশ সরকার এই সংকট সমাধানে সব পক্ষের সহযোগিতা নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

