বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্ক গত ৫৪ বছরে সবচেয়ে বড় পরিবর্তনের দিকে এগোচ্ছে। অনেক দিন ধরেই এই সম্পর্ক একরকম স্থবির ছিল। কিন্তু এখন সেটা শুধু সচল নয় বরং স্পষ্ট রূপান্তরের পথে। কূটনীতিকদের মতে, দুই দেশই পুরোনো জটিলতা সরিয়ে নতুন কিছু শুরু করতে চাইছে।
দেশি-বিদেশি বিশ্লেষকরাও বলছেন, এই সম্পর্কের ধরনে বড় পরিবর্তন আসছে। বিবিসিসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম এ নিয়ে রিপোর্ট করেছে। সেগুনবাগিচা থেকে জানানো হয়েছে, বাংলাদেশ বর্তমান বাস্তবতা মেনে পাকিস্তানের সঙ্গে আবারও সংলাপে বসতে চায়।
চলতি মাসেই পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও সচিব ঢাকা সফরে আসবেন। প্রায় ১৪ বছর পর এই সফর হতে যাচ্ছে। এ সময় ষষ্ঠ ফরেন অফিস কনসালটেশন বা রাজনৈতিক সংলাপ অনুষ্ঠিত হবে। সর্বশেষ এ ধরনের সংলাপ হয়েছিল ২০১০ সালে ইসলামাবাদে।
ডেইলি পাকিস্তান জানায়, ঢাকায় আসন্ন সংলাপ দুই দেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্ক নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। পাকিস্তানের পক্ষে প্রতিনিধিত্ব করবেন দেশটির পররাষ্ট্র সচিব আমেনা বেলুচ। আলোচনায় থাকবে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক সহযোগিতা বাড়ানোর বিষয়।
পাকিস্তানের উপ-প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দারও এ মাসেই ঢাকা আসবেন। তবে সফরের নির্দিষ্ট দিন এখনো জানানো হয়নি। পাকিস্তানি গণমাধ্যম বলছে, ২২ থেকে ২৪ এপ্রিল তার সফর হতে পারে। ইসলামাবাদ এই সফরকে কূটনৈতিক এবং বাণিজ্যিক সুযোগ হিসেবে দেখছে।
ডেইলি পাকিস্তান বলেছে, শেখ হাসিনার সরকার বিদায় নেওয়ার পর দুই দেশের সম্পর্ক নতুন মাত্রায় যাচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকার পাকিস্তানের সঙ্গে সামরিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক বাড়াতে চায়। একই সঙ্গে বাংলাদেশ চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড প্রকল্পে আরও জড়াতে আগ্রহী। এতে এই অঞ্চলে কৌশলগত সম্পর্ক আরও গভীর হতে পারে।
পাকিস্তানের অতিরিক্ত পররাষ্ট্র সচিব ইমরান আহমেদ সিদ্দিকী সম্প্রতি ঢাকা সফর করেন। তিনি জানান, এবার পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ে আলোচনা এবং যৌথ অর্থনৈতিক কমিশনের সভাও হবে। পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ে শেষ আলোচনা হয়েছিল ২০১০ সালে। আর অর্থনৈতিক কমিশনের সভা হয়েছিল ২০০৫ সালে। ইসহাক দারের সফর নিয়েও আলোচনা করেন তিনি।
সম্পর্ক উন্নয়নে কিছু বাস্তব পদক্ষেপও নেওয়া হয়েছে। গত নভেম্বরে পাকিস্তানের করাচি থেকে একটি কনটেইনার জাহাজ সরাসরি চট্টগ্রাম বন্দরে এসেছে। এর আগে এমন কিছু হয়নি। এছাড়া, পাকিস্তানি নাগরিকদের জন্য বাংলাদেশে ভিসা পাওয়া সহজ করা হয়েছে। ভিসার ফি মওকুফ করার ঘোষণাও এসেছে।
গত ডিসেম্বরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত বিদেশিদের জন্য ভিসার প্রক্রিয়াও সহজ করা হয়েছে। এসব পদক্ষেপ সম্পর্ক উন্নয়নে ইতিবাচক বার্তা দিচ্ছে।
এ বছরের ১৪ জানুয়ারি বাংলাদেশের সামরিক কর্মকর্তা জেনারেল এসএম কামরুল হাসান ইসলামাবাদ সফর করেন। তিনি পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল অসিম মুনিরের সঙ্গে বৈঠক করেন।
পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় চেম্বার অব কমার্স ও ইন্ডাস্ট্রিজের একটি প্রতিনিধি দলও ঢাকায় আসে। এক দশকে এই প্রথম কোনো উচ্চপর্যায়ের ব্যবসায়ী প্রতিনিধি দল বাংলাদেশে এল। তারা বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে দেখা করেন এবং যৌথ ব্যবসায়িক কাউন্সিল গঠনের জন্য একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেন।
তবে ১৯৭১ সালের ইতিহাস এখনো দুই দেশের সম্পর্কের বড় বাধা। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নৃশংসতা এখনো অনেক কিছুকে ছায়ার মতো ঢেকে রাখে। অনেক বিষয় এখনো অমীমাংসিত রয়ে গেছে।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ১৯৭১ সালের পর থেকে দুই দেশের সম্পর্ক প্রায় বন্ধই ছিল। তার মতে, সম্পর্ক এগোতে হলে পাকিস্তানকে গণহত্যার জন্য দুঃখপ্রকাশ করতে হবে এবং ক্ষতিপূরণের বিষয়ে আলোচনা করতে হবে।
পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মিস বেলুচ বলেন, ১৯৭১ সালের বেদনাদায়ক ইতিহাস দুই দেশই বহন করে। তবে ১৯৭৪ সালের চুক্তিতে এ সমস্যার সমাধানের পথ ছিল।
পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ও বর্তমান সরকার এ বিষয়ে আলোচনা করেছেন। কিন্তু এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চাওয়া হয়নি। মিস বেলুচ মনে করেন, পুরোনো ইতিহাস ভুলে নতুন করে শুরু করার সময় এসেছে। ক্ষমা চাওয়ার প্রক্রিয়াও শুরু হওয়া উচিত।
১৯৭৪ সালের বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ভারতের ত্রিপক্ষীয় চুক্তি এবং পরবর্তী ঘটনাগুলোর আলোকে দুই দেশের সম্পর্ক নতুন দিকে যেতে পারে।
এই সম্পর্ক ভবিষ্যতে কোথায় যাবে এবং তাতে কার কী লাভ হবে—এ নিয়ে বিশ্লেষকদের মতভেদ আছে। তবে সবারই মত, ১৯৭১ সালের অতীত মূল্যায়ন এবং সেটা মোকাবিলা করেই নতুন সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে।

