এপ্রিল মাসের শুরুতে থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে অনুষ্ঠিত হলো বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলন। বঙ্গোপসাগরীয় সাতটি দেশের এই জোটের নেতারা সাত বছর পর একসঙ্গে মিলিত হলেন। সম্মেলনের উদ্বোধনী দিনে নেতারা একসঙ্গে ছবি তোলেন। ছবিতে দেখা যায়, সবাই নিজ নিজ দেশের জাতীয় বা আনুষ্ঠানিক পোশাকে। এই বৈচিত্র্য যেমন সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধির প্রতীক, তেমনি অনৈক্যেরও ইঙ্গিত দেয়। বিমসটেকের এই ভিন্নতা আসিয়ানের একরকম ঐক্যবদ্ধ ছবি তোলার ধরন থেকে একেবারেই আলাদা।
১৯৯৭ সালে গঠিত বিমসটেকের সদস্য দেশগুলো হলো—বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার, নেপাল ও ভুটান। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াকে একত্রে নিয়ে তৈরি এই জোটটি দীর্ঘ সময় নানা রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক টানাপোড়েনে স্থবির হয়ে ছিল। ব্যাংকক সম্মেলন ছিল সেই স্থবিরতা কাটিয়ে ওঠার একটি প্রয়াস।
সম্মেলনের সবচেয়ে আলোচিত উপস্থিতি ছিল মিয়ানমারের জান্তা প্রধান সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লাইং। ২০২১ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর তিনি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রায় একঘরে হয়ে পড়েন। এমন অবস্থায় এই সম্মেলনে তাঁর অংশগ্রহণ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ফেরানোর কৌশল হিসেবেই দেখছেন বিশ্লেষকরা। তার আগেই মিয়ানমারে এক ভয়াবহ ভূমিকম্প ঘটে, যা বিষয়টিকে আরও গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে।
সম্মেলনে আরেকটি কূটনৈতিক দিক ছিল ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের মুখোমুখি সাক্ষাৎ। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারবিরোধী আন্দোলন দমনে কঠোর পদক্ষেপের পর ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ভারতে আশ্রয় নেন। মোদি-ইউনূস বৈঠকে কোনো চুক্তি না হলেও, উভয়ের অগ্রাধিকার স্পষ্ট হয়। ইউনূস শেখ হাসিনাকে প্রত্যর্পণের অনুরোধ জানান। মোদি বলেন, বাংলাদেশে হিন্দু সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
বিমসটেকের যাত্রা শুরু হয় যখন বিশ্বজুড়ে আঞ্চলিক সহযোগিতার জোট গঠনের ধারা শুরু হয়। ২০০৪ সালে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির উদ্যোগ নেওয়া হলেও মিয়ানমারের সামরিক শাসন ও পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কারণে তা থেমে যায়।
২০১০ সালের পর কিছু অগ্রগতি দেখা যায়। মিয়ানমারে বেসামরিক সরকার আসে, আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়। ভারতের ‘লুক ইস্ট’ নীতিও ‘অ্যাক্ট ইস্ট’-এ রূপ নেয়। ২০১৬ সালে ঢাকায় বিমসটেকের স্থায়ী সচিবালয় গঠিত হয়। একই বছরে বিমসটেক নেতারা ব্রিকস সম্মেলনে আমন্ত্রিত হন। এতে জোটটির কৌশলগত গুরুত্ব বাড়ে।
তবে এরপরই আসে কোভিড মহামারি। বন্ধ হয়ে পড়ে আঞ্চলিক কার্যক্রম। ২০২১ সালে মিয়ানমারে ফের সামরিক অভ্যুত্থান হয়। এরপর ২০২৪ সালে বাংলাদেশে ঘটে রাজনৈতিক পরিবর্তন। এই দুই ঘটনায় বিমসটেকের ভবিষ্যৎ আবার প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে।
ভারতের জন্য বিমসটেক কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ‘সেভেন সিস্টার্স’ নামে পরিচিত। এই অঞ্চল মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত মাত্র ২২ কিলোমিটার প্রস্থের শিলিগুড়ি করিডরের মাধ্যমে, যা ‘চিকেনস নেক’ নামে পরিচিত। এখানেই মিয়ানমারকে ট্রানজিট করে গড়ে উঠছে ‘এশিয়ান হাইওয়ে’। কিন্তু মিয়ানমারের সংকট এই প্রকল্পে বড় বাধা তৈরি করেছে।
থাইল্যান্ডও পশ্চিম দিকে অর্থনৈতিক প্রভাব বাড়াতে চায়। জাপানের সঙ্গে তারা মিয়ানমারের দাওয়ে বন্দরের উন্নয়নে কাজ করছে। তবে মিয়ানমারের রাজনৈতিক অস্থিরতা থাইল্যান্ডের ‘লুক ওয়েস্ট’ কৌশলকেও বিপদে ফেলেছে।
তবুও ব্যাংকক সম্মেলনে কিছু অগ্রগতি হয়েছে। ছয়টি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এর মধ্যে সামুদ্রিক পরিবহন সহযোগিতা চুক্তি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এতে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সংযোগ জোরদার হবে।
এদিকে মিয়ানমারে সংকটের সুযোগ নিয়ে চীন বাড়িয়েছে নিজেদের প্রভাব। ‘স্ট্রিং অব পার্লস’ কৌশলে বেইজিং ভারত মহাসাগরে বন্দর ও ঘাঁটি গড়ে তুলেছে। শ্রীলঙ্কার হাম্বানতোটা ও মিয়ানমারের কায়াকপায়ু বন্দর তার উদাহরণ। চীন এখন গ্রেট কোকো দ্বীপে নজরদারি কেন্দ্রও চালু করছে।
এ অবস্থায় ভারতও চুপ নেই। রাখাইন রাজ্যের সিত্তে বন্দরে উন্নয়ন প্রকল্প চালাচ্ছে। আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে সামরিক ঘাঁটি গড়ে তুলেছে, যা চীনের গ্রেট কোকো ঘাঁটির খুব কাছে।
মিয়ানমার এখন চীন-ভারত সামুদ্রিক প্রতিযোগিতার কেন্দ্রবিন্দুতে। অথচ মিয়ানমারের জান্তার সঙ্গে ভারতের ঘনিষ্ঠতা কিছুটা বিস্ময় তৈরি করেছে। সম্মেলনে মোদি ও মিন অং হ্লাইংয়ের বৈঠক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর সমালোচনার মুখে পড়ে।
সম্মেলনের প্রাক্কালে ইউনূস বেইজিং সফরে গিয়ে চীনা প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের সঙ্গে বৈঠক করেন। সেখানে তিনি বাংলাদেশকে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জন্য “সমুদ্রের একমাত্র অভিভাবক” হিসেবে উল্লেখ করেন। এই মন্তব্য ভবিষ্যতে ভারত-বাংলাদেশ কূটনীতিতে নতুন টানাপোড়েন সৃষ্টি করতে পারে।
সব মিলিয়ে ব্যাংকক সম্মেলন শুধু একটি আনুষ্ঠানিক বৈঠক ছিল না। এটি ছিল দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাজনৈতিক বাস্তবতা, কৌশলগত প্রতিযোগিতা ও অভ্যন্তরীণ সংকটের একটি প্রতিচ্ছবি।

