বিদেশে কাজ করতে গিয়ে ২০২৪ সালে ৪ হাজার ৮১৩ জন বাংলাদেশি অভিবাসী প্রাণ হারিয়েছেন। রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিট (রামরু)- এর এক গবেষণা অনুযায়ী, আগের বছরের তুলনায় এই সংখ্যা ৫ দশমিক ৭ শতাংশ বেশি। যদিও অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই মৃত্যুগুলিকে ‘স্বাভাবিক মৃত্যু’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। গবেষণা বলছে, মৃত্যুর প্রকৃত কারণ নিয়ে রয়েছে অস্পষ্টতা, সন্দেহ এবং ক্ষোভ।
বৃহস্পতিবার ঢাকার প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন এবং রামরুর যৌথ উদ্যোগে অনুষ্ঠিত এক সংলাপে এসব তথ্য উপস্থাপন করেন রামরুর নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক তাসনিম সিদ্দিকী এবং মৃত অভিবাসীদের পরিবারের সদস্যরা। সংলাপের শিরোনাম ছিল: ‘লাশ হয়ে ফিরে আসা অভিবাসী কর্মীর সম্মান ও মর্যাদা।’
রামরুর ২০২২ সালের গবেষণায় দেখা গেছে, বিদেশে মারা যাওয়া অভিবাসীদের গড় বয়স মাত্র ৩৮ বছর, অথচ তাঁদের অনেকের দেহে আঘাতের চিহ্ন থাকা সত্ত্বেও মৃত্যুর সার্টিফিকেটে কোনো ব্যাখ্যা নেই। গবেষণা অনুযায়ী, ৪৮ শতাংশ পরিবার মৃত্যুর সনদে উল্লেখিত কারণকে সন্দেহজনক মনে করে।
আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য হলো, মৃতদের ৩১ শতাংশ দুর্ঘটনা, আত্মহত্যা কিংবা হত্যার শিকার হয়েছেন- যা গভীরভাবে উদ্বেগজনক। গবেষণা বলছে, অনেকে মৃত্যুর আগে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন, আবার কারও দেহে আঘাতের চিহ্ন ছিল- সবকিছু মিলিয়ে মৃত্যুর ঘটনাগুলোকে ‘স্বাভাবিক’ বলা কঠিন।
২০২৪ সালে যারা মৃত্যুবরণ করেছেন, তাদের মধ্যে ৯৪ দশমিক ৪ শতাংশ ছিলেন পুরুষ এবং ৩ দশমিক ৬ শতাংশ নারী। এই সংখ্যা অভিবাসন ব্যবস্থাপনায় অন্ধকার একটি দিকের নির্দেশ করে।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সচিব সেবাস্টিয়ান রেমা বলেন, “এই মৃত্যুগুলোর পেছনে অনেক অজানা কারণ রয়েছে। আন্তর্জাতিক ফোরামে বিষয়টি তুলে ধরার মাধ্যমে মৃত্যুর হার কমানোর পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব।”
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. নেয়ামত উল্লাহ ভূঁইয়া বলেন, “মরদেহ ব্যবস্থাপনায় আন্তঃমন্ত্রণালয় সমন্বয় জরুরি। ছোট পদক্ষেপই বড় পরিবর্তনের পথ দেখাতে পারে।”
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক এটিএম আব্দুর রউফ মন্ডল বলেন, “যদি ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের তহবিল থেকে মরদেহ ফেরত আনা সম্ভব না হয়, তাহলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিজস্ব বাজেট থেকে তা সম্পন্ন করা হবে।”
এছাড়া মরদেহ সংরক্ষণের জন্য নির্ধারিত স্থান এবং শোকাহত পরিবারের সদস্যদের বসার জায়গার ব্যবস্থার কথাও তিনি তুলে ধরেন।
বিএমইটির পরিচালক মাসুদ রানা জানান, রিইন্টিগ্রেশন প্রকল্পে মৃত অভিবাসীদের পরিবারদের অন্তর্ভুক্তি জরুরি। তিনি বলেন, “অর্থনৈতিক ক্ষতির পাশাপাশি পরিবারের মানসিক যন্ত্রণা লাঘবে সরকারিভাবে পুনর্বাসনের উদ্যোগ থাকা দরকার।”
সাবেক সচিব সেলিম রেজা বলেন, “দুর্ঘটনার পেছনে শ্রমিকদের সচেতনতার অভাবও অন্যতম কারণ। মৃতদেহ প্রত্যাবর্তনের ক্ষেত্রে কিছু উন্নতি হলেও, প্রক্রিয়াটি আরও সহজ এবং স্ট্রিমলাইন করা সম্ভব।”
বিশ্লেষকদের মতে, প্রবাসী শ্রমিকের মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ার পাশাপাশি যে তথ্য উঠে এসেছে, তা গভীর উদ্বেগের। অনেক ক্ষেত্রে পরিবার জানতে পারে না মৃত্যুর প্রকৃত কারণ। কখনও কখনও মৃত্যুর পরেও তারা ক্ষতিপূরণ কিংবা সহায়তা থেকে বঞ্চিত হয়।
এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক তাসনিম সিদ্দিকী বলেন, “এই মানুষগুলো দেশের অর্থনীতিতে মুখ্য ভূমিকা রাখে, অথচ তাঁদের মৃত্যুর পর কাঙ্ক্ষিত সম্মান ও মর্যাদা দেওয়া হয় না। এটি শুধু একটি মানবাধিকার ইস্যু নয়, বরং নৈতিক দায়বদ্ধতার প্রশ্নও।”
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অভিবাসী শ্রমিকদের মৃত্যুর প্রকৃত কারণ অনুসন্ধানে নিরপেক্ষ তদন্তের ব্যবস্থা করা উচিত। আন্তর্জাতিক মৃত্যুসংক্রান্ত প্রটোকল অনুসরণ করে, দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় সমঝোতা স্মারকে এ বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
এছাড়া প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, মানবাধিকার সংস্থা ও নাগরিক সমাজকে নিয়ে একটি সার্বক্ষণিক তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা গড়ে তোলার দাবি উঠেছে সংলাপে।
দেশের অর্থনৈতিক প্রবাহে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা প্রবাসী কর্মীরা অনেক সময়ই প্রান্তিক অবস্থানে থাকেন- জীবিত থাকাকালে যেমন: মৃত্যুর পরও তেমনি। প্রবাসে প্রতি বছর হাজারো বাংলাদেশির মৃত্যু হচ্ছে কিন্তু তাঁদের মৃত্যুর কারণ রহস্যজনকভাবে ‘স্বাভাবিক’ বলে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
এখানে জরুরি হয়ে উঠেছে, রাষ্ট্রীয়ভাবে এই ইস্যুকে অগ্রাধিকার দিয়ে, যথাযথ তদন্ত, মর্যাদাপূর্ণ মরদেহ ফেরত আনা এবং পরিবারের পুনর্বাসনের জন্য একটি সমন্বিত নীতি গ্রহণ। না হলে- বাংলাদেশের এই ‘প্রবাসী নায়কদের’ মৃত্যু শুধু সংখ্যার হিসাব হয়েই থেকে যাবে।

