“মানুষ বই পড়লে পৃথিবী বদলায়”—এই বিশ্বাসই ছিল আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের জীবনের চালিকাশক্তি। তিনি মনে করেন, আজকের সুন্দর ও উন্নত জীবনের পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান বইয়ের। এ বিশ্বাস থেকেই তিনি নিজের পুরো জীবন উৎসর্গ করেছেন বই পড়ানোর কাজে।
প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে তিনি চেষ্টা করে যাচ্ছেন বইকে মানুষের জীবনঘনিষ্ঠ করে তুলতে। তাঁর অভিজ্ঞতায় তিনি বুঝেছেন, বই পড়া আন্দোলন সফল করতে হলে শিশু ও কিশোরদের দিয়েই শুরু করতে হবে। এ কারণে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের কার্যক্রম বিস্তৃত হয়েছে দেশের নানা প্রান্তের স্কুল-কলেজে।
ঢাকা কলেজে ৩০ বছর অধ্যাপনার পর সায়ীদ স্যার হয়ে উঠেছেন সারা দেশের ছাত্রদের প্রিয় শিক্ষক। যদিও তিনি একটি মাত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করেছেন, তবু কোটি ছাত্র মনে করে—তারা সবাই তাঁর ছাত্র। কারণ, পরের তিন দশকে তাঁর পাঠচক্র ছড়িয়ে পড়েছে গোটা বাংলাদেশে।
লেখক, উপস্থাপক, শিক্ষক, সংগঠক—সায়ীদ স্যার ছিলেন বহুমাত্রিক। একজন শিক্ষার্থী, একজন সাহিত্যকর্মী ও একজন নাগরিক হিসেবে তাঁর কাছ থেকে আমি পেয়েছি দিকনির্দেশনা। তিনি শুধু বই পড়তে উৎসাহ দেননি, দেখিয়েছেন দীপ্তিময় জীবনের স্বপ্ন।
ষাটের দশক থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত দেশজুড়ে গড়ে তুলেছেন অগণিত পাঠচক্র। কখনো কলেজের ক্লাসরুমে, কখনো গ্রিন রোডের ছোট্ট ঘরে, আবার কখনো টিএসসির সড়কদ্বীপে কিংবা বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে—সবখানেই সায়ীদ স্যারের পাঠচক্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।
একটি কবিতা বা গল্পের পাঠ দিয়েই তিনি তরুণদের সাহিত্য-ভুবনে ডুব দিয়েছেন। টেলিভিশনে শিক্ষা-সংস্কৃতিকে কেন্দ্র করে নির্মাণ করেছেন ব্যতিক্রমধর্মী বিনোদনের পরিমণ্ডল। ‘কণ্ঠস্বর’-এর মতো পত্রিকা সম্পাদনার মাধ্যমে তরুণ লেখকদের মধ্যে জাগিয়ে তুলেছেন সৃজনশীলতা।
বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের যাত্রা শুরুর পর থেকে তিনি নিজ হাতে পাঠচক্রের পাঠ্যসূচি তৈরি করেছেন। পাঠপ্রক্রিয়ায় যুক্ত করেছেন উৎকর্ষ অর্জনের নতুন নতুন পদ্ধতি। চিরায়ত সাহিত্য পাঠে শিক্ষার্থীদের আগ্রহ জাগিয়ে তুলেছেন নিজ হাতে।
বাংলাদেশে বই পড়ানোয় যাঁরা পেশাগতভাবে সম্পূর্ণ আত্মনিবেদন করেছেন, তাঁদের মধ্যে এমন নিবেদন সায়ীদ স্যারের মধ্যে সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে। তিনি শুধু পড়িয়েই থেমে থাকেননি, সাহিত্যের প্রতি ভালোবাসা ছড়িয়ে দিয়েছেন সমাজে।
তাঁকে নিয়ে কবি আমীরুল ইসলাম বলেন, “আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ ঘটনা হলো সায়ীদ স্যারের সঙ্গে পরিচয়।” ফরিদুর রেজা সাগর জন্মদিনে লেখেন, “আজ প্রাতে সূর্য ওঠা সফল হলো কার।” শামীম আজাদ বলেন, “তিনি মুক্ত মুগ্ধ বাতায়ন।” আনিসুল হক লিখেছেন, “স্যারের ফ্ল্যাট ছোট হতে পারে, কিন্তু তাঁর আকাশটা বড়।”
বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রাণ হলো স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রী। দেশের যেকোনো প্রান্তে, যেকোনো প্রতিষ্ঠানে থাকুক না কেন, এ শিক্ষার্থীরা সবাই সায়ীদ স্যারের ছাত্র। তাই কোনো দুর্ঘটনার সংবাদ এলেই কেন্দ্র ছেয়ে যায় বিষাদে। আমরা প্রার্থনা করি—তিনি দীর্ঘজীবী হোন, বারবার ফিরে আসুক তাঁর জন্মদিন। কারণ, এই জন্মদিন মানেই একটি আলোকযাত্রার উৎসব।

