ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামীর ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবির সমর্থিত প্যানেল ব্যাপক বিজয় অর্জন করেছে। সহসভাপতি (ভিপি), সাধারণ সম্পাদক (জিএস)সহ ২৩টি পদে তারা জয়ী হয়েছেন।
দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষার্থীরা ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনের দাবি তুলছিলেন, যা এবার বাস্তব রূপ পেয়েছে। আশা করা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ক্যালেন্ডারে ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচন নিয়মিত অংশ হিসেবে সংরক্ষিত হবে।
ভোটের সামগ্রিক পরিবেশ ছিল শান্তিপূর্ণ, উৎসবমুখর এবং অংশগ্রহণমূলক। ডান-বাম ও মধ্যপন্থী রাজনৈতিক ছাত্রসংগঠন এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীরা মিলিয়ে ১০টি প্যানেল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছে। আটটি ভোটকেন্দ্রে সকাল থেকেই শিক্ষার্থীরা লাইনে দাঁড়িয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোট প্রদান করেছেন। কিছু ছোটখাটো অসংগতি ও ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটি ছাড়া বড় ধরনের অনিয়ম ধরা পড়েনি। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের পর্যবেক্ষণেও এ বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছে।
প্রায় ৭৮ শতাংশ শিক্ষার্থী ভোট দিয়েছেন, যা অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক। তবে নারী শিক্ষার্থীদের ভোটদানের হার ছিল ৬৬ দশমিক ৭ শতাংশ।
সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক সামিনা লুৎফা বলেছেন, শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ সত্যিই অভূতপূর্ব।
নির্বাচনে বিজয়ী ও পরাজিত হওয়া গণতন্ত্রের স্বাভাবিক অংশ। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, শিক্ষার্থীরা নিজেদের প্রতিনিধি নিজেদের ভোটে নির্বাচিত করেছেন।
তফসিল ঘোষণার পর থেকে ডাকসু নির্বাচনকে ঘিরে যে উদ্দীপনা ও সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশ দেখা গেছে, তা শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষণীয়। আশা করা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন মতের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সহনশীলতা ও সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশ অটুট থাকবে।
নব্বইয়ের পর থেকে ক্ষমতায় থাকা দলগুলো বিশ্ববিদ্যালয়কে নিজেদের লেজুড়বৃত্তির রাজনীতির মঞ্চে পরিণত করেছিল। ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনের নেতা-কর্মীদের সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর কর্তৃত্ব ও নিপীড়ন নিয়মিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল, যা ছাত্রলীগের সময় সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছিল। শিক্ষার্থীরা চাইবেন না সেই ধরনের কর্তৃত্ববাদী ও নিপীড়নমূলক ছাত্ররাজনীতি ফিরে আসুক।
এক্ষেত্রে নির্বাচিত ডাকসু প্রতিনিধিদের দায়িত্ব হচ্ছে, ইশতেহারে দেওয়া প্রতিশ্রুতি যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গেস্টরুম, গণরুমের মতো নিপীড়নমূলক ব্যবস্থার অবসান নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষার্থীদের জোরপূর্বক বা নিজেদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে সংগঠনে বা মিছিলে অংশগ্রহণ করানোর পুনরাবৃত্তি যেন আর না ঘটে।
নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে কোনো প্রার্থীর মধ্যে অভিযোগ বা অসন্তোষ থাকা অস্বাভাবিক নয়। তবে তা নিয়মতান্ত্রিক পথে সমাধান হতে হবে। নির্বাচনের সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশমুখে বিএনপি ও জামায়াতের নেতা-কর্মীদের অবস্থান গ্রহণ কোনোভাবেই প্রত্যাশিত ছিল না।
রাজনৈতিক দলগুলোকে মনে রাখতে হবে যে, ২৪-এর গণ-অভ্যুত্থান নতুন জন–আকাঙ্ক্ষা তৈরি করেছে। শিক্ষাঙ্গন কোনোভাবেই দলীয় লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতির মঞ্চ হতে পারবে না।
ডাকসু নির্বাচন যে শান্তিপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের নজির স্থাপন করেছে, আমরা আশা করব জাহাঙ্গীরনগর, রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচনে একই ধারাবাহিকতা বজায় থাকবে।
বিশ্ববিদ্যালয়কে গণতান্ত্রিক ও বহুত্ববাদী মতচর্চার কেন্দ্র হিসেবে উন্নীত করা গুরুত্বপূর্ণ। নির্বাচিত ডাকসু নেতৃত্ব শিক্ষার্থীদের বৈধ প্রতিনিধি হিসেবে ২৪-এর অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা ধারণ করে শিক্ষার্থীদের দাবিদাওয়া বাস্তবায়নে সচেষ্ট হবেন বলে আশা করা যায়।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করার দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, ডাকসু নেতৃত্ব ও ছাত্রনেতৃত্ব—তিনপক্ষকেই আন্তরিকভাবে নিতে হবে।