ঢাকার মগবাজার ও তেজগাঁওয়ে নিম্ন আয়ের মানুষরা টিসিবি ট্রাকের ভর্তুকি মূল্যের পণ্যের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন। রিকশাচালক সাইদুল ইসলাম বলেন, ‘আমি তিন দিন ধরে টিসিবির ট্রাক খুঁজে ঘুরছি, কিন্তু পাচ্ছি না। আগে লাইনে দাঁড়ালে অন্তত দুই লিটার তেল, ডাল আর চিনি পাওয়া যেত। এখন বাজারে দাম শুনে রিকশা ঠেলতে মন চায় না।’
শুধু সাইদুল নয়, তেজগাঁওয়ের গার্মেন্টকর্মী রুবিনা আক্তারও একই সংকটে পড়েছেন। তিনি জানান, ‘টিসিবির ট্রাক থেকে ভর্তুকি মূল্যে পণ্য কিনে পরিবার চালানোর সামান্য স্বস্তি মিলত। এখন সেটি হঠাৎ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আমরা বড় বিপদে পড়েছি।’ দেশে প্রায় তিন বছর ধরে নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে।
গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর তথ্য অনুযায়ী, এ সময়ে দারিদ্র্যের হার প্রায় ১০ শতাংশ বেড়ে ২৮ শতাংশে পৌঁছেছে। বিশেষ করে খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধিই মানুষকে সবচেয়ে বেশি কষ্ট দিচ্ছে।
একটি সাধারণ পরিবার বর্তমানে আয়ের অর্ধেকের বেশি খাবারে ব্যয় করছে। ফলে চিকিৎসা, শিক্ষা বা বাসা ভাড়া সামলানো কঠিন হয়ে পড়েছে। রুবিনা আক্তার বলেন, ‘এক ডজন ডিম কিনতে গেলে ঘরে চাল থাকে না। ডাল, তেল আর চিনি একসঙ্গে কিনে খাওয়ার সামর্থ্য নেই। টিসিবির ট্রাক ছিল আমাদের শেষ ভরসা।’
টিসিবি ট্রাক সেল অনেক বছর ধরে নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য স্বস্তির আশ্রয় ছিল। এখানে তেল, চিনি ও ডাল বাজারদরের তুলনায় অনেক কম দামে বিক্রি হতো। উদাহরণস্বরূপ, বাজারে তেল লিটার ১৭৫–১৮০-১৯০ টাকার মধ্যে বিক্রি হয়, ট্রাকে পাওয়া যেত ১১৫ টাকায়; ডাল ৯০–১২০ টাকার পরিবর্তে ৭০ টাকা; চিনি ৮৫-৯০ টাকার পরিবর্তে ৬৫–৭০ টাকায়। দীর্ঘ বিরতির পর গত ১০ আগস্ট ট্রাক সেল পুনরায় চালু হয়, তবে বাজেট সংকট ও লোকবলের ঘাটতির কারণে মাত্র এক মাস পরই, ১৩ সেপ্টেম্বর, কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়।
টিসিবির উপপরিচালক (বাণিজ্যিক) শাহাদাত হোসেন জানান, ‘ফ্যামিলি কার্ড চালুর পর ট্রাকে ভর্তুকি মূল্যে বিক্রি করা ব্যয়সাধ্য হয়ে গেছে। প্রতিটি ট্রাক সেলের পণ্যে সরকারের বিশাল ভর্তুকি দিতে হয়। ফলে দীর্ঘমেয়াদে এই কর্মসূচি চালানো সম্ভব নয়। তবে সরকারের সিদ্ধান্তে চাইলে যে কোনো সময় পুনরায় চালু করা সম্ভব।’
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, টিসিবির ট্রাক সেল ক্ষণস্থায়ী স্বস্তি দিলেও এটি কোনো স্থায়ী সমাধান নয়। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক ড. মুস্তফা কামাল মুজেরী বলেন, ‘খাদ্যমূল্যস্ফীতি এত বেড়েছে যে নিম্ন আয়ের মানুষের বেঁচে থাকা এখন কঠিন হয়ে পড়েছে। কেবল ভর্তুকি দিয়ে কদিন টেকা যায়? স্থায়ী সমাধান হলো মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং রেশনিং প্রথা বিস্তৃতভাবে চালু করা।’
তিনি সতর্ক করে বলেন, ‘বর্তমানে প্রায় ২৮ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে, আর আরও ১৮ শতাংশ ঝুঁকিতে রয়েছে। নিত্যপণ্যের দাম সামান্য ওঠানামাও এই শ্রেণির মানুষের খাবারের টেবিলে বড় সংকট তৈরি করে। নিয়মিত, স্বচ্ছ ও সাশ্রয়ী বিতরণ ব্যবস্থা না থাকলে সামাজিক অস্থিরতা বাড়বে।’
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘ট্রাক সেলের মাধ্যমে সীমিত আকারে হলেও দরিদ্র মানুষ কিছুটা স্বস্তি পাচ্ছিল। বাজারদর নিয়ন্ত্রণে না থাকায় ভর্তুকি মূল্যের চাল, ডাল, তেল, চিনি তাদের জন্য নিরাপত্তার বলয় তৈরি করেছিল। হঠাৎ করে এ কর্মসূচি বন্ধ করা হলো। ফলে শ্রমজীবী ও দিন আনা-দিন খাওয়া মানুষ বড় সংকটে পড়েছে। এটি নীতিগত অসংগতির প্রকাশ। সরকার একদিকে দরিদ্রের কষ্ট লাঘবের কথা বলছে, অন্যদিকে কার্যকর সহায়তা তুলে নিচ্ছে। এর বদলে কর্মসূচির পরিধি বাড়ানো উচিত ছিল।’
নির্মাণ কাজে নিযুক্ত হেলপার জাকির বলেন, ‘তিন ঘণ্টা লাইনে দাঁড়ালেও ৪৫০ টাকায় তেল, ডাল, চিনি পাওয়া যেত। বাইরে কিনলে ৬৫০ টাকা খরচ হতো। এই পার্থক্য আমাদের মতো মানুষের জন্য অনেক।’
এছাড়া, এই ব্যবস্থার বন্ধ হওয়ার ফলে নিম্ন আয়ের মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় সরাসরি প্রভাব পড়েছে। খাদ্যপণ্যের দাম সামান্য বৃদ্ধি হলেও- পরিবারের বাজেট প্রভাবিত হচ্ছে। অনেক পরিবার এখন বাজারে বেশি মূল্য দিয়ে কিনছে, যার ফলে শিশুরা ঠিকমতো পুষ্টি পাচ্ছে না এবং শিক্ষার খরচও কমে যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, দীর্ঘমেয়াদে এ ধরনের সংকট সামাজিক অস্থিরতার কারণ হতে পারে।
অর্থনীতিবিদরা আরো বলছেন, সরকারের উচিত টিসিবি ট্রাক সেলের মতো ভর্তুকি কার্যক্রমকে পুনরায় চালু করা এবং দেশের অন্যান্য অঞ্চলেও সম্প্রসারণ করা, যাতে নিম্ন আয়ের মানুষরা নিয়মিত ও স্বল্পমূল্যে খাদ্যপণ্য পেতে পারে। পাশাপাশি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা ও বাজারে প্রতারণা রোধ করা খুবই জরুরি।
ডিটিসিএও জানিয়েছে, নতুন সফটওয়্যার ও সেবা উন্নয়নের মাধ্যমে টিসিবি ট্রাক সেলের কার্যক্রম আরও সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। ভবিষ্যতে এই সিস্টেম মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস ও ভিসা/মাস্টারকার্ডের মাধ্যমে রিচার্জ করা যাবে। পরে এটি গুলশান চাকা, ঢাকা চাকা ও বিআরটিসি বাসে চালু করার পরিকল্পনা রয়েছে।
ডিটিসিএর পরিচালক নীলিমা আখতার বলেন, ‘এটি কেবল শুরু হয়েছে। মানুষকে মানিয়ে নিতে সময় লাগবে। আমরা আশা করি, অন্য পরিবহন খাতও এ মডেল অনুসরণ করবে। প্রযুক্তি নিয়মিত হালনাগাদ হবে এবং সেক্টর ক্রমেই উন্নত হবে।’