বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ জলবায়ু নিয়ে বিশেষ সতর্কবার্তা দিয়েছে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর এবং নরওয়েজিয়ান মেটিওরোলজিক্যাল ইনস্টিটিউটের যৌথ গবেষণা। চলতি শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকেই দেশে অস্বাভাবিক উষ্ণতা, দীর্ঘ তাপপ্রবাহ, অতিবৃষ্টি, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং শীতের প্রায় বিলুপ্তির মতো বড় পরিবর্তন দেখা দিতে পারে—যা আমাদের জীবন, জীবিকা এবং স্বাস্থ্যকে সরাসরি ঝুঁকির মুখে ফেলবে।
এই গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয় ঢাকার একটি হোটেলে, যেখানে বিজ্ঞানীরা স্পষ্ট করে বলেছেন—এটাই আমাদের ভবিষ্যৎ, এবং এই ভবিষ্যৎ থেকে পালানো সম্ভব নয়; প্রস্তুতি ও অভিযোজনই একমাত্র উপায়।
তাপমাত্রা বাড়ছে ভয়ংকর গতিতে—৪.৫ ডিগ্রি পর্যন্ত উষ্ণ হতে পারে বাংলাদেশ
গবেষণা বলছে, যদি গ্রিনহাউস গ্যাস কমানো না যায়, তাহলে—
-
২০৪১–২০৭০ সালের মধ্যে তাপমাত্রা বাড়বে ১–২ ডিগ্রি সেলসিয়াস,
-
২১০০ সালের মধ্যে তা পৌঁছাতে পারে ৪.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে।
এই বৃদ্ধিটা শুধু গরমের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না—
শীতকালেও তাপমাত্রা বাড়বে, এমনকি শতাব্দীর শেষে বাংলাদেশে শীত মৌসুম প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে।
বিশেষভাবে দেশের পশ্চিমাঞ্চল সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সেখানে মার্চ–মে মাসে তাপপ্রবাহ প্রায় নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়াবে।
তাপপ্রবাহ: ৯০ দিনের মধ্যে ৭০ দিনই গরম!
গবেষণার সবচেয়ে উদ্বেগজনক তথ্য হলো—
২১০০ সালের মধ্যে দেশের পশ্চিমাঞ্চলে বর্ষা শুরুর আগের ৯০ দিনের মধ্যে ৭০ দিনই তাপপ্রবাহ চলতে পারে।
এখনকার তুলনায় এই হার কয়েক গুণ বেশি।
ঢাকাতেও প্রতিবছর অন্তত দুটি তীব্র তাপপ্রবাহের সম্মুখীন হতে হবে—একটি বর্ষার আগে, আরেকটি বর্ষার পরে।
তাপমাত্রা বৃদ্ধির ধরন:
-
৩৬–৩৮°সেঃ → মৃদু তাপপ্রবাহ
-
৩৮–৪০°সেঃ → মাঝারি তাপপ্রবাহ
-
৪০–৪২°সেঃ → তীব্র তাপপ্রবাহ
-
৪২°সেঃ-এর ওপরে → অতি তীব্র তাপপ্রবাহ
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২০৭০ সালের মধ্যে তীব্র তাপপ্রবাহের স্থায়িত্ব ১৩ দিন পর্যন্ত হতে পারে, আর ২১০০ সালে তা পৌঁছাতে পারে ২০ দিনে।
শীত কমবে, অনেক অঞ্চলে পুরোপুরি হারিয়েও যেতে পারে
প্রতিবেদন বলছে—এই শতাব্দীর শেষ নাগাদ উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে শীত আর থাকবে না বললেই চলে।
উত্তর বা উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জেলাগুলোতে ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে মাত্র ১–২ দিন শৈত্যপ্রবাহ দেখা যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
অর্থাৎ, শীত আর ঋতু হিসেবে থাকবে না—অল্প সময়ের কিছু ঠাণ্ডা বাতাস হয়তো অনুভূত হবে, কিন্তু প্রচলিত শীতের অস্তিত্ব বিলুপ্তির পথে।
বৃষ্টিপাত বাড়বে—অতিরিক্ত বর্ষা, অতিবৃষ্টি, বন্যা ও ভূমিধস
গবেষণায় স্পষ্ট বলা হয়েছে—
আগামী দশকগুলোতে বর্ষায় বৃষ্টির পরিমাণ বাড়বে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত।
-
২০৭০ সালের মধ্যে বর্ষার বৃষ্টি বাড়বে ১১৮ মিমি।
-
২১০০ সালের মধ্যে তা বাড়বে ২৫৫ মিমি পর্যন্ত।
সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি ঝরবে উত্তর-পূর্বাঞ্চলে (সিলেট অঞ্চল), যার ফলে বন্যা, ভূমিধস এবং দীর্ঘমেয়াদি জলাবদ্ধতা বাড়বে।
সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা: উপকূলের ১৮% এলাকা পানির নিচে যেতে পারে
বিশ্বের গড় বৃদ্ধির চেয়েও দ্রুত হারে বাড়বে বাংলাদেশের উপকূলীয় সমুদ্রপৃষ্ঠ।
-
প্রতি বছর বাড়তে পারে ৫.৮ মিলিমিটার
-
শতাব্দীর শেষে উপকূলের ১৮% এলাকা স্থায়ীভাবে প্লাবিত হতে পারে
-
প্রায় ১০ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে ২০৫০ সালের মধ্যে
-
সবচেয়ে ভয়াবহ পূর্বাভাস: সুন্দরবনের ২৩% পর্যন্ত এলাকা পানিবন্দি হয়ে পড়তে পারে
লবণাক্ততা বৃদ্ধি হলে ক্ষতি হবে—
-
ধান ও অন্যান্য ফসল
-
মিঠাপানির মাছ
-
পানির উৎস
-
উপকূলের বাস্তুতন্ত্র
স্বাস্থ্যঝুঁকি: ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া, পানিবাহিত রোগ বাড়বে বহুগুণ
তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে—
-
ডেঙ্গু
-
ম্যালেরিয়া
-
পানিবাহিত রোগ
-
শিশুর খর্বকায় হওয়ার ঝুঁকি (স্টান্টিং)
বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে। গবেষণায় বলা হয়েছে—
গরম ১% বাড়লে শিশুর খর্বকায় হওয়ার ঝুঁকি বাড়তে পারে ৫৬%।
এ ছাড়া শ্রমিকদের কাজ করার সক্ষমতা কমে যাবে, হিট স্ট্রেস বাড়বে, উৎপাদনশীলতা কমে যাবে।
কৃষি ও জীবিকায় বড় ধরনের আঘাত
অতিরিক্ত বৃষ্টি, খরা, তাপপ্রবাহ, লবণাক্ততা—সব মিলিয়ে কৃষিখাত বড় সংকটে পড়বে।
বাংলাদেশের ধান, গম, ঘাস, সবজি, মাছ—সবক্ষেত্রেই উৎপাদন কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
এতে জীবন-জীবিকা, খাদ্য নিরাপত্তা, কর্মসংস্থান—সবকিছু চাপের মুখে পড়ছে।
এখনই ব্যবস্থা নেওয়ার সময়: প্রশমন + অভিযোজন
গবেষণায় স্পষ্ট বলা হয়েছে—
জলবায়ু পরিবর্তন রাতারাতি বন্ধ করা সম্ভব নয়।
তাই দুই পথে কাজ করতে হবে—
- প্রশমন (Mitigation) → দূষণ কমানো, পুনর্নবীকরণযোগ্য জ্বালানি
- অভিযোজন (Adaptation) → বাঁধ, আশ্রয়কেন্দ্র, জলবায়ু-সহনশীল কৃষি, প্রযুক্তি, নগর পরিকল্পনা
বাংলাদেশ ইতোমধ্যে জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনার আওতায় কিছু পদক্ষেপ নিচ্ছে, তবে তা যথেষ্ট নয় বলে গবেষকরা সতর্ক করেছেন।
নরওয়ের রাষ্ট্রদূতের ভাষায়—
“এটি গুরুত্বপূর্ণ সতর্কবার্তা। রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত এখন থেকেই প্রস্তুতি নেওয়া।”
জলবায়ু পরিবর্তন আর কোনো দূরের সংকট নয়; এটি আমাদের ঘরের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রক্ষায়—দূষণ কমানো, পরিকল্পনা নেওয়া, এবং বিজ্ঞানকে গুরুত্ব দেওয়া ছাড়া আর কোনো পথ নেই।

