দীর্ঘ ১৬ বছরের অপেক্ষার পর অবশেষে পিলখানা হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচন করল জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশন। রোববার প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে জমা দেওয়া প্রায় ৪০০ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে উঠে এসেছে বহু স্পর্শকাতর ও অজানা তথ্য, যেগুলো এত দিন অন্ধকারেই চাপা ছিল। এই প্রতিবেদনে উঠে এসেছে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, প্রশাসনিক নিষ্ক্রিয়তা, গোয়েন্দা ব্যর্থতা এবং প্রভাবশালী বিভিন্ন ব্যক্তির ভূমিকার জটিল সমন্বয়—যা কমিশন সরাসরি রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতা হিসেবে মন্তব্য করেছে।
অর্ধশতাধিক প্রভাবশালী ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ
কমিশন জানিয়েছে, পিলখানা হত্যাকাণ্ড কোনো হঠাৎ ঘটনার ফল নয়; বরং এটি ছিল দীর্ঘমেয়াদি ষড়যন্ত্র, যেখানে যুক্ত ছিলেন আওয়ামী লীগের তৎকালীন ক্ষমতার বিভিন্ন স্তরের নেতা, সেনাবাহিনীর সাবেক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, গোয়েন্দা সংস্থার সদস্য, র্যাব ও বিডিআরের কর্মকর্তারা, এমনকি গণমাধ্যমের তিন কর্মীও।
তালিকায় মোট অনুমানিক ৪৯ জনকে দায়ী করা হয়েছে।
রাজনৈতিক নেতৃত্বের ভূমিকা
প্রতিবেদনে সবচেয়ে আলোচিত নাম—তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কমিশন বলেছে, বিদ্রোহের সময়ে বিডিআর মহাপরিচালক শাকিল আহমেদের অনুরোধ সত্ত্বেও তিনি উদ্ধার অভিযানে সেনা পাঠাতে তড়িঘড়ি সিদ্ধান্ত নেননি। ‘রাজনৈতিক সমাধান’ খোঁজার নামে এই সময়ক্ষেপণ বিদ্রোহীদের সংগঠিত হতে এবং কর্মকর্তাদের হত্যার সুযোগ দেয়।
এ ছাড়া ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপসকে প্রতিবেদনে অন্যতম প্রধান সমন্বয়কারী বলা হয়েছে। বিদ্রোহীদের সঙ্গে তাঁর একাধিক বৈঠক, পরিকল্পনা বিনিময় এবং পরে অভিযুক্তদের পালিয়ে যেতে সহায়তার বিষয়টিও উল্লেখ করা হয়েছে।
শেখ ফজলুল করিম সেলিম, জাহাঙ্গীর কবির নানক, মির্জা আজম, কামরুল ইসলাম, ওয়ারেসাত হোসেন বেলাল, মাহবুব আরা গিনি, আসাদুজ্জামান নূর, সোহেল তাজসহ মোট ১৭ জন রাজনৈতিক নেতার নাম এসেছে।
প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে—এই পরিকল্পনার প্রতিটি ধাপে রাজনৈতিক অনুমোদন ছিল এবং “সবুজ সংকেত” পাওয়ার পরই মূল অপারেশন শুরু হয়।
ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার সম্পৃক্ততা
দ্বিতীয় প্রতিবেদনের সবচেয়ে আলোচিত তথ্য—পিলখানা হত্যাকাণ্ডে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার ২৪ জন কর্মকর্তা সরাসরি ভূমিকা রেখেছেন বলে কমিশনের দাবি।
বৈঠক, পরিকল্পনা, পাসপোর্টধারীদের অস্বাভাবিক আগমন–বহির্গমন, বিদেশি ভাষায় কথোপকথন শোনার ঘটনা—সবকিছু মিলিয়ে তদন্ত দল এটিকে “গুরুত্বপূর্ণ বিদেশি সম্পৃক্ততা” হিসেবে উল্লেখ করেছে।
২৪ থেকে ২৭ ফেব্রুয়ারির মধ্যে ৮২৭ জন ভারতীয় পাসপোর্টধারী ও ভারতীয় বংশোদ্ভূত বিদেশি বাংলাদেশে প্রবেশ করলেও তাঁদের মধ্যে ৬৫ জনের বহির্গমনের রেকর্ড নেই। একই সময়ে আরো ৫৭ জনের আগমনের কোনো নথি নেই—যা কমিশনের কাছে সন্দেহজনক মনে হয়েছে।
সাবেক সেনা কর্মকর্তা ও গোয়েন্দাদের ভূমিকা
প্রতিবেদনে সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল মইন ইউ আহমেদ, সাবেক নৌবাহিনী প্রধান ভাইস অ্যাডমিরাল জহির উদ্দীন আহমেদ, সাবেক বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার মার্শাল এসএম জিয়াউর রহমানসহ সেনাবাহিনীর একাধিক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার নাম এসেছে।
কমিশন বলেছে, তাদের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত, নিষ্ক্রিয়তা, তথ্য গোপন এবং পরবর্তী সময়ে দায়হীন তদন্ত পুরো ঘটনাকে আরও জটিল করে তুলেছিল।
বিদ্রোহের আগের বৈঠক ও পরিকল্পনার ধাপ
তদন্তে উঠে এসেছে—
-
ব্যারিস্টার তাপস পিলখানার কেন্দ্রীয় মসজিদে বিডিআর সদস্যদের সঙ্গে বৈঠক করতেন।
-
এরপর তাঁর বাসায় শেখ সেলিমের উপস্থিতিতে আরেকটি বৈঠকে অফিসারদের জিম্মি করার পরিকল্পনা হয়।
-
পরে সোহেল তাজ, শেখ সেলিম ও ভারতের গোয়েন্দা দলের উপস্থিতিতে হত্যাকাণ্ডের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
-
তাপসকে দেওয়া হয় বিদ্রোহীদের নিরাপদে পালিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব।
কমিশন বলেছে, বিদ্রোহ শুরুর সময় পিলখানায় হিন্দি, পশ্চিমবঙ্গীয় টানে বাংলা এবং অজানা ভাষায় কথোপকথন শোনার বিষয়ে একাধিক সাক্ষ্য পাওয়া গেছে।
হত্যাকাণ্ডের পরের ধাপ: সত্য গোপনের অভিযোগ
জাহাঙ্গীর কবির নানক ও মির্জা আজমের বিরুদ্ধে অভিযোগ—
তারা সাদা পতাকা দেখিয়ে ভেতরে গিয়ে হত্যাকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে এবং পরে বাইরে এসে বাস্তব পরিস্থিতি গোপন রাখেন।
অ্যাম্বুলেন্স দিয়ে পালাতে সহায়তা, লাশ গুম, লুটপাট—এমন ১৩টি অভিযোগ তাদের বিরুদ্ধে আনা হয়েছে।
সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনের বিরুদ্ধে অভিযোগ—তিনি অস্ত্র সমর্পণের প্রহসন পরিচালনা এবং তদন্ত জটিল করতে ভূমিকা রাখেন।
সেনা অভিযান ঠেকিয়ে দেওয়ার অভিযোগ
শেখ হাসিনার নিরাপত্তা উপদেষ্টা তারিক আহমেদ সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে অভিযোগ—তিনি সেনা অভিযান চালানোর বিপক্ষে অবস্থান নেন এবং র্যাবকে পিলখানায় প্রবেশে বাধা দেন।
ব্রিগেডিয়ার জেনারেলদের মধ্যে কয়েকজনের বিরুদ্ধে চেইন অব কমান্ড ভাঙাসহ ষড়যন্ত্রের বিভিন্ন তথ্যও প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
কমিশনের সুপারিশ
স্বাধীন তদন্ত কমিশন জানিয়েছে—এ ঘটনার বিচার এখনো অসম্পূর্ণ।
তারা নতুন করে তদন্ত, আইনগত ব্যবস্থা এবং বিদেশি সম্পৃক্ততার বিষয়ে বিস্তারিত অনুসন্ধানের সুপারিশ করেছে।
সরকারের প্রতিক্রিয়া
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লে. জেনারেল জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, প্রতিবেদনটি অত্যন্ত বড় এবং গুরুত্বপূর্ণ। সরকার পুরো প্রতিবেদন পড়ে সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করবে।
ভারতের সম্পৃক্ততার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন—পুরো প্রতিবেদন পড়া ছাড়া মন্তব্য করা ঠিক হবে না।
পিলখানা হত্যাকাণ্ড: স্মরণ
২০০৯ সালের ২৫–২৬ ফেব্রুয়ারি বিডিআর সদর দপ্তরে বিদ্রোহে ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ মোট ৭৪ জন নির্মমভাবে নিহত হন।
ঘটনার ১৬ বছর পর এই নতুন তদন্ত প্রতিবেদন আবারও পুরো দেশকে আলোচনায় ফিরিয়ে এনেছে।

