ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে রাজধানী ঢাকায় যেন আবারও পুরোনো সেই দৃশ্য—রাস্তায় রাস্তায়, গলি থেকে প্রধান সড়ক পর্যন্ত ছড়িয়ে গেছে বিভিন্ন দলের প্রচারণার পোস্টার। নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে, শহরের চেহারা যেন ততই কাগজ-ফেস্টুনে ঢেকে যাচ্ছে। অথচ বিস্ময়কর ব্যাপার হলো—এবারই প্রথমবারের মতো নির্বাচন কমিশন (ইসি) আচরণবিধিতে স্পষ্টভাবে পোস্টার ব্যবহারের ওপর সরাসরি নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।
কিন্তু বাস্তব চিত্র বলছে অন্য গল্প।
ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে দেখা যায়, গাছ, দেয়াল, রোড ডিভাইডার, বৈদ্যুতিক খুঁটি, ওভারব্রিজ—কোথাও জায়গা খালি নেই। রাজনৈতিক নেতাদের হাস্যোজ্জ্বল ছবি আর বড় বড় স্লোগান যেন শহরের প্রতিটি ইঞ্চিতে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। এমনকি নির্বাচন ভবনের সামনেও ঝুলছে বিভিন্ন দলের পোস্টার ও বিলবোর্ড—যা নিজেরাই আচরণবিধির সবচেয়ে বড় লঙ্ঘন।
ইসি যে ‘রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর আচরণ বিধিমালা–২০২৫’ জারি করেছে, সেখানে পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছে—
পোস্টার নিষিদ্ধ।
অতিরিক্ত আকারের বিলবোর্ড নিষিদ্ধ।
রঙিন ফেস্টুন নিষিদ্ধ।
তবুও কারো যেন এতে বিশেষ মাথাব্যথা নেই।
গত মাসে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিনও ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “ঢাকা শহর পোস্টারে ঢেকে গেছে, অথচ আমরা তো নিষিদ্ধ করেছি। এগুলো সরাতে হবে। তফসিল ঘোষণার পর আমরা কঠোর হবো।”
তাঁর আরও বক্তব্য—বিধিভঙ্গ হলে “উই উইল নট স্পেয়ার”, অর্থাৎ ছাড় দেওয়া হবে না।
১০ নভেম্বর প্রকাশিত আচরণবিধিতে আরও বলা হয়েছে—
• কোনও দল বিদেশে গিয়ে প্রচার করতে পারবে না।
• একজন প্রার্থী সর্বোচ্চ ২০টি বিলবোর্ড ব্যবহার করতে পারবেন।
• বিলবোর্ডের মাপ নির্ধারিত—১৬×৯ ফুট।
কিন্তু এখন শহরে যে বিলবোর্ডগুলো চোখে পড়ে, তার অনেকগুলোই এই সীমার বহুদূর বাইরে।
ডিজিটাল বিলবোর্ডে আলো ব্যবহার করা গেলেও অন্যধরনের আলোকসজ্জা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে উল্লেখ আছে। আবার ব্যানার, লিফলেট, ফেস্টুন—সবই হতে হবে সাদা-কালো। আকারও নির্ধারিত:
• ব্যানার – ১০×৪ ফুট
• লিফলেট – এ৪ সাইজ
• ফেস্টুন – ১৮×২৪ ইঞ্চি
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ম—প্রার্থীর ব্যানারে প্রার্থী নিজে ও দলের প্রধান ছাড়া অন্য কারো ছবি ব্যবহার করা যাবে না।
দিয়ে রাখা হয়েছে আরও কঠোর নির্দেশনাও। কেউ কোনও ভবন, দেয়াল, গাছ বা সরকারি স্থাপনায় কিছু লাগাতে পারবে না। যানবাহনেও প্রচারসামগ্রী সাঁটানো নিষিদ্ধ। ভোটার স্লিপ ছাপালেও সেখানে প্রার্থীর নাম ও ছবি রাখা যাবে না। পরিবেশের ক্ষতি করে এমন কোনও উপাদান ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
সবকিছুর মধ্যেও বড় প্রশ্ন—নিষেধাজ্ঞা মানা হচ্ছে কোথায়?
নির্বাচন কমিশন বলছে, তফসিল ঘোষণার পরে তারা কঠোর ব্যবস্থা নেবে। নির্বাচন কমিশনার আব্দুর রহমানেল মাউসদ জানান—“তফসিলের পরই আমাদের কার্যক্রম শুরু হবে। যারা নিয়ম ভাঙবে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
তবে তাঁকে মনে করিয়ে দিলে যে ইসি আগেই পোস্টার সরানোর কথা বলেছিল, তিনি বলেন, “আমাদের জুড়ি ডিকশন থাকে না। তফসিলের পরই মূল শুরু।”
মজার ব্যাপার হলো—যেসব বিলবোর্ড এখন লাগানো আছে, সেগুলোর অনেকই নির্ধারিত মাপের চেয়ে অনেক বড়। এ বিষয়ে জানতে চাইলে কমিশনারের উত্তর—“মাপের বাইরে হলে জানান, আমরা সরাতে বলবো। বিলবোর্ডে আমরা শক্ত অবস্থানে আছি।”
সংশোধিত আচরণবিধি অনুযায়ী, বিধিভঙ্গ করলে সর্বোচ্চ ছয় মাসের কারাদণ্ড, দেড় লাখ টাকা জরিমানা—বা উভয় দণ্ডই হতে পারে। প্রয়োজন হলে প্রার্থিতা পর্যন্ত বাতিল করা যাবে।
এদিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনও আলাদা গণবিজ্ঞপ্তি দিয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, শহরে অনুমতি ছাড়াই লাগানো পোস্টার, ফেস্টুন, সাইনবোর্ড ও নির্বাচনি প্রচারপত্র দ্রুত নিজ উদ্যোগে সরিয়ে নিতে হবে। অন্যথায় আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
অর্থাৎ একদিকে নিয়ম-কানুন কড়া, অন্যদিকে বাস্তবে চলছে পোস্টারের মৌতাত।
এখন দেখার বিষয়—
তফসিল ঘোষণার পর সত্যিই কি রাজধানীর আকাশ-জমিন ভরা পোস্টারের বন্যায় লাগাম টানতে পারবে নির্বাচন কমিশন?
নাকি নিয়ম কাগজেই থাকবে, শহর ভরবে আগের মতোই কাগজের জঙ্গলে?

