বাংলাদেশে শিক্ষা নিশ্চিত করা এবং সব শিশুকে বিদ্যালয়ে পৌঁছে দেওয়া নিয়ে গত কয়েক দশক ধরে সরকার নানা প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এর সঙ্গে দেশি ও বিদেশি এনজিওরাও শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। তবু বর্তমান সময়ে দেশের প্রায় ৪২ শতাংশ মানুষ এখনও পঞ্চম শ্রেণীর নিচের শিক্ষাগত যোগ্যতাই অর্জন করতে পারেনি। এটি দীর্ঘমেয়াদি শিক্ষানীতি ও প্রকল্পের কার্যকারিতা নিয়ে নতুন প্রশ্ন উত্থাপন করছে।
উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো (বিএনএফইউ) জানায়, ১৯৯০ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে সরকার ১১টি বড় শিক্ষা প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। এসব প্রকল্পে সাক্ষরতা বৃদ্ধি, ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের পুনরায় স্কুলে ফিরিয়ে আনা এবং প্রাপ্তবয়স্কদের শিক্ষা নিশ্চিত করা ছিল মূল লক্ষ্য। তবু দেশজুড়ে অর্ধেকের বেশি জনগণ প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষারও নিচে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অশিক্ষিত জনগণ শুধু শ্রমবাজারে নয়, উৎপাদনশীলতা, প্রযুক্তি গ্রহণ এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। তাদের মতে, সমস্যা সমাধানে শুধু প্রকল্প নয়, পরিবার-সমাজ পর্যায়ে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং ঝরে পড়ার মূল কারণ চিহ্নিত করা জরুরি।
সম্প্রতি প্রকাশিত হেলথ অ্যান্ড মরবিডিটি স্ট্যাটাস সার্ভে ২০২৫-এর তথ্য অনুযায়ী, দেশের ২৩.৫১ শতাংশ মানুষ কখনো বিদ্যালয়ে যায়নি। আর ১৮.৯৪ শতাংশ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শুরু করলেও সম্পূর্ণ করতে পারেনি। এই হিসেবে ৪২.৪৫ শতাংশ জনগোষ্ঠীর শিক্ষাগত যোগ্যতা পঞ্চম শ্রেণীর নিচে। অন্যদিকে, মাধ্যমিক বা তদূর্ধ্ব শিক্ষাগত যোগ্যতাধারীর সংখ্যা ২২.৭৪ শতাংশ।
প্রতিবেদনে আরও দেখা গেছে, কখনো বিদ্যালয়ে না যাওয়া জনগোষ্ঠীর মধ্যে নারীর সংখ্যা বেশি—২৪.৭৪ শতাংশ, যেখানে পুরুষের হার ২২.২৩ শতাংশ। এছাড়া ২০২২ সালের জনশুমারি ও গৃহগণনা রিপোর্টেও এই সমস্যার পরিচয় মিলেছে। ওই প্রতিবেদনে দেখা গেছে, পাঁচ বছর বা তদূর্ধ্ব বয়সীদের মধ্যে ২৫.৯২ শতাংশের সাক্ষরতা নেই। এমনকি চুয়াডাঙ্গা জেলা, যেখানে নব্বইয়ের দশকে নিরক্ষরমুক্ত ঘোষণা করা হয়েছিল, সেখানে এখনও ২৫ শতাংশের বেশি মানুষ প্রাথমিক স্তরের নিচে শিক্ষিত।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বলছেন, “শিক্ষা কোনো আলাদা বিষয় নয়। এটি পরিবার ও অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত। যেসব পরিবারে দুই বেলা খাবারের নিশ্চয়তা নেই, তাদের সন্তান বিদ্যালয়ে পাঠানো হলেও ঝরে পড়ার সম্ভাবনা বেশি। কার্যকর সাক্ষরতা নিশ্চিত করতে হলে শিক্ষা ও অর্থনীতির সমন্বয় অপরিহার্য।”
পরীক্ষা ও জরিপের তথ্যও এই ধারণাকে সমর্থন করছে। বান্দরবানে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার হার বেশি, আর একই জেলার দারিদ্র্য হারও ৬৫.৩৬ শতাংশ। শিক্ষাবিদদের মতে, দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য সহায়তা না বাড়ালে শিক্ষা কার্যক্রমে কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আসবে না।
সরকার দীর্ঘদিন ধরে প্রাথমিক ও উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার মানোন্নয়ন এবং ব্যবস্থাপনা উন্নয়নের জন্য পদক্ষেপ নিয়েছে। সম্প্রতি একটি নয় সদস্যের পরামর্শক কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির প্রধান ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মনজুর আহমেদ জানিয়েছেন, “প্রকল্পগুলো গ্রহণ করা হয়েছিল ঠিকই, তবে কার্যকারিতা আশানুরূপ হয়নি। প্রাথমিক শিক্ষার মানও সন্তোষজনক নয়।”
উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর মহাপরিচালক দেবব্রত চক্রবর্তী বলেন, “শতভাগ সাক্ষরতা অর্জনের জন্য কাজ চলছেই। তবে প্রকল্পগুলোতে পরিকল্পনা ও মনিটরিংয়ের ঘাটতি আছে। এখন আমরা কার্যকর প্রকল্প নিয়ে আরও ভালো কিছু করার চেষ্টা করছি।”
বর্তমানে সরকার শুধু সাক্ষরতা নয়, কার্যকর ও দক্ষ শিক্ষা নিশ্চিত করতেও উদ্যোগ নিচ্ছে। বিভিন্ন জেলায় প্রাথমিক শিক্ষা, কারিগরি প্রশিক্ষণ ও কর্মমুখী শিক্ষার সমন্বয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। আগামীতে “আলো” নামে একটি নতুন প্রকল্প চালু হবে। এর একটি অংশ ঝরে পড়াদের পুনরায় স্কুলে ফেরানো, অন্যটি কার্যকর সাক্ষরতা এবং কর্মমুখী শিক্ষা প্রদান করবে।
শিক্ষাবিদরা মনে করেন, শুধু প্রকল্প গ্রহণ নয়, পরিবার-বিদ্যালয় সমন্বয়, শিক্ষক প্রশিক্ষণ, বিদ্যালয়ের পরিবেশ উন্নয়ন এবং শিক্ষার্থীর শেখার ফলাফলের ওপর নজর দিলে দেশে কার্যকর ও গুণগত সাক্ষরতা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।

