রাজধানী ঢাকায় বড় ধরনের ভূমিকম্পের সম্ভাবনা বিশেষজ্ঞদের জন্য দীর্ঘদিনের উদ্বেগের বিষয়। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, মধুপুর ফল্টে ৬.৯ মাত্রার ভূমিকম্প ঘটলে রাজধানীর প্রায় ৪০ শতাংশ ভবন—অর্থাৎ প্রায় সাড়ে ৮ লাখ ভবন—ধসে পড়তে পারে। এতে ২ লাখ ১০ হাজার থেকে ৫ লাখ মানুষ প্রাণ হারাতে পারেন, এবং অন্তত আড়াই লাখ মানুষ গুরুতরভাবে আহত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকবেন।
কিন্তু এ ধরনের বিপর্যয় রোধ করার জন্য জরুরি ভূমিকম্প সহনশীল ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনা এবং ভবনের কাঠামোগত নিরাপত্তা অডিট এখনও কার্যকরভাবে শুরু হয়নি। বিশ্বব্যাংকের ৫৬৮ কোটি টাকার আরবান রেজিলিয়েন্স প্রকল্পের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হলেও সরকারি দায়িত্ব ও সংশ্লিষ্ট সংস্থার উদাসীনতার কারণে কার্যক্রম দীর্ঘদিন ফাইলবন্দি অবস্থায় আছে।
বিশেষজ্ঞদের সতর্কবার্তা
বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ও ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ ড. মেহেদী আহমেদ আনসারী বলেন, ঢাকার মতো শহরকে ভূমিকম্প সহনশীল করতে হলে দুটি প্রধান পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রথমত, ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা নির্ধারণ করে ভূমিকম্প সহনশীল ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনা করা। দ্বিতীয়ত, ভবন বা স্থাপনার কাঠামোগত নিরাপত্তা নিয়মিতভাবে পরীক্ষা করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া।
তিনি আরও বলেন, রাজউক ভূমিকম্প সহনশীল ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনা তৈরি করেছে, তবে এটি এখনও তাদের মাস্টারপ্ল্যান ড্যাপে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। একই সঙ্গে বেসরকারি পর্যায়ে কাঠামোগত নিরাপত্তা নিরীক্ষা কার্যক্রমও শুরু হতে হবে। দেশে ইতোমধ্যেই কয়েকটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এই কাজ শুরু করেছে। রানা প্লাজার বিপর্যয়ের পর গার্মেন্টসের প্রায় ৩,৫০০ ভবনের ফিটনেস যাচাই করা হয়েছিল।
রাজউকের আরবান রেজিলিয়েন্স প্রকল্পের আওতায় মহাখালীতে একটি স্টিল স্ট্রাকচারের ১০ তলা ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। এখানে উন্নতমানের যন্ত্রপাতি ক্রয় করা হয়েছে। তবে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো অত্যন্ত ব্যয়বহুল যন্ত্র কিনতে পারছে না। সরকার ইতোমধ্যে শতকোটি টাকার যন্ত্রপাতি কিনে রেখেছে, যা বেসরকারি পর্যায়ে ব্যবহার করে কার্যক্রম জোরদার করার সুযোগ রয়েছে।
রাজউকের সাবেক প্রকল্প পরিচালক ও ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ প্রযন্ত ইঞ্জিনিয়ার ড. মো. আব্দুল লতিফ হেলালী বলেন, “জাপানেও ভূমিকম্প সহনশীল শহর গড়ে তুলতে প্রায় ৩০ বছর লেগেছে। ঢাকাকে একইভাবে নিরাপদ করতে অন্তত ৫০ বছর লাগবে। তবে দুঃখজনকভাবে, কাজ শুরু হওয়ার পর তা আবার স্থগিত হয়ে গেছে।”
প্রকল্প ও যন্ত্রপাতির আটকে থাকা পরিস্থিতি
তথ্য অনুসন্ধানে জানা গেছে, আরবান রেজিলিয়েন্স প্রকল্প শুরু হয় ২০১৫ সালের জুলাইয়ে এবং বিশ্বব্যাংকের ঋণ সহায়তায় প্রকল্পের কাজ শেষ হয় ২০২৪ সালের জুনে। কিন্তু প্রকল্পের সুপারিশ অনুযায়ী গঠিত প্রতিষ্ঠান এখনও কার্যকর হয়নি। মহাখালীতে নির্মিত স্টিল স্ট্রাকচারের ১০ তলা ভবন এবং শতকোটি টাকার প্রযুক্তি এখনও ব্যবহারবিহীন অবস্থায় পড়ে আছে। ২১ নভেম্বর ৫.৭ মাত্রার ভূমিকম্পের পর রাজউক ও গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে।
প্রকল্পের অধীনে ক্রয় করা যন্ত্রপাতির মধ্যে রয়েছে—দুটি ২০০ কিলোনিউটন ক্ষমতার ট্র্যাক মাউন্টেড সিপিটি মেশিন, একটি ১২ ইঞ্চির কাটার ক্রেন, ৪০ টন ক্ষমতার ওভারহেড ক্রেন, ৫ টন ক্ষমতার ফর্কলিফটসহ মোট ১৫০ ধরনের যন্ত্রপাতি। এই যন্ত্র ব্যবহার করে দেশের বিভিন্ন স্থাপনা পরীক্ষার মাধ্যমে ভূমিকম্প সহনশীলতা যাচাই করা হবে।
ঢাকার ঝুঁকির মানচিত্র
রাজউকের জরিপ অনুযায়ী—
-
১.৫% এলাকা অতি ঝুঁকিপূর্ণ, যেখানে কোনো স্থাপনা করা যাবে না।
-
২৬% এলাকায় উন্নয়ন সীমিত রাখতে হবে।
-
১৩% এলাকায় উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ জরুরি।
-
২৯% এলাকায় ঝুঁকি তুলনামূলক কম।
ঢাকায় মোট ভবন ২১ লাখের বেশি, যার মধ্যে ৬ লাখ পাকা। মধুপুর ফল্টে বড় ভূমিকম্প ঘটলে প্রায় ৭৫ হাজার পাকা ভবন ধসে পড়তে পারে।
রাজউকের অবস্থান ও পরিকল্পনা
রাজউক চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. রিয়াজুল ইসলাম জানান, নগরীর ভবন নির্মাণে এখনও কিছু ব্যত্যয় থাকলেও ভূমিকম্প সহনশীল অবকাঠামো নির্মাণ নিশ্চিত করার কাজ চলছে। নতুনভাবে একটি ট্রাস্ট গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, যার মাধ্যমে ভবনগুলো ফিটনেস যাচাই-বাছাই করে মার্কিং করা হবে।
রাজউকের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ মো. আশরাফুল ইসলাম জানান, বিশ্বব্যাংকের প্রকল্পের আওতায় দুর্যোগ সহনশীল ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনা তৈরি করা হয়েছে। তবে বিদ্যমান ড্যাপে তা অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব হয়নি। ড্যাপ সংশোধন হলে এই পরিকল্পনা অন্তর্ভুক্ত হবে।
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেন—প্রকল্প বাস্তবায়ন ও ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনা বিলম্বিত হলে ঢাকায় সম্ভাব্য ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি অकल्पনীয় মাত্রার হতে পারে। দ্রুত পদক্ষেপই রাজধানীকে বড় বিপর্যয় থেকে রক্ষা করতে পারে।

