শরিফ ওসমান হাদির ওপর হামলার ঘটনার পর দেশের নিরাপত্তা ইস্যুতে সরকার সতর্কতা জোরদার করেছে। বিভিন্ন বন্দর দিয়ে মিথ্যা ঘোষণায় অস্ত্র, গোলাবারুদ ও নাশকতামূলক পণ্য যাতে দেশে প্রবেশ করতে না পারে, সে বিষয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) কঠোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে এ বিষয়ে বিশেষ সতর্কতা আরোপ করা হয়েছে।
সরকারি পর্যায়ে আশঙ্কা করা হচ্ছে, নাশকতা চালাতে ড্রোন ব্যবহার হতে পারে। এ কারণে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ছাড়া ড্রোন আমদানিতেও কড়াকড়ি করা হয়েছে। একই সঙ্গে বন্দর ব্যবস্থাপনায় নজরদারি আরও জোরদার করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় গতকাল এনবিআর দেশের সব বন্দরে নিয়মিত কর্মকর্তাদের পাশাপাশি গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানোর নির্দেশ দিয়েছে। এই বিশেষ ব্যবস্থা আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের পরবর্তী সাত দিন পর্যন্ত বহাল থাকবে। স্থল, সমুদ্র ও বিমানবন্দর—সবখানেই সমান গুরুত্ব দিয়ে নজরদারি চালানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান বলেন, বন্দর নজরদারি এনবিআরের নিয়মিত দায়িত্বের অংশ। সারা বছরই কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এ কাজে গুরুত্ব দেন। তবে নির্বাচন সামনে রেখে যাতে কেউ কোনো ধরনের অপতৎপরতা বা নাশকতা চালাতে না পারে, সে জন্য সরকার বাড়তি সতর্কতা নিয়েছে। মিথ্যা ঘোষণায় নাশকতামূলক কোনো পণ্য দেশে ঢোকানো ঠেকাতে এনবিআর সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে রয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনবিআরের গোয়েন্দা শাখার এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, আসন্ন নির্বাচন বানচাল করতে বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের কিছু লোক সক্রিয় হয়ে উঠেছে বলে গোয়েন্দা তথ্য রয়েছে। মিথ্যা ঘোষণায় আগ্নেয়াস্ত্র, গোলাবারুদ, বোমা তৈরির রাসায়নিক, ড্রোনসহ বিভিন্ন ক্ষতিকর পণ্য বন্দর দিয়ে আনার চেষ্টা হতে পারে। এসব আশঙ্কা মাথায় রেখে এনবিআর গুরুত্ব দিয়ে প্রস্তুতি নিয়েছে।
এনবিআর সূত্র জানায়, প্রধান কার্যালয় থেকে ইতোমধ্যে সব বন্দরকে সতর্ক থাকতে এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বিশেষ নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে বেনাপোল, সোনামসজিদ, আখাউড়া ও হিলি স্থলবন্দরে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।
এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মো. আবদুল মজিদ বলেন, অতীতেও বিভিন্ন সময়ে মিথ্যা ঘোষণায় অস্ত্র ও গোলাবারুদ দেশে ঢোকার চেষ্টা ধরা পড়েছে এনবিআর কর্মকর্তাদের তৎপরতায়। তবে লোকবল সংকটের কারণে সব সময় এসব চেষ্টা ঠেকানো সম্ভব হয় না। নির্বাচন সামনে রেখে নাশকতার ষড়যন্ত্রের খবর গণমাধ্যমেও এসেছে। এ অবস্থায় এনবিআরকে আরও সতর্ক থাকতে হবে।
প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে এনবিআরে পাঠানো এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় থেকেই বিগত সরকারের সুবিধাভোগী প্রভাবশালীদের অনেকেই দেশে ও বিদেশে আত্মগোপনে আছেন। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা তাদের অবস্থান শনাক্তে কাজ করছে। এরই মধ্যে ভারত, নেপালসহ প্রতিবেশী দেশ ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র, দুবাই, সিঙ্গাপুর, তুরস্ক ও ইউরোপের কয়েকটি দেশে তাদের অবস্থানের তথ্য মিলেছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন বানচাল করতে একটি বিশেষ গোষ্ঠী দেশ-বিদেশে তৎপরতা বাড়িয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নির্বাচন বানচালের হুমকিও দেওয়া হচ্ছে। জুলাই আন্দোলনে অংশ নেওয়া তরুণদের জীবননাশের হুমকির তথ্যও রয়েছে। এরই মধ্যে হত্যা, হামলা ও সংঘর্ষের মতো ঘটনাও ঘটেছে। এসব পরিস্থিতিতে আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটানোর চেষ্টা হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। নাশকতার জন্য অস্ত্র, গোলাবারুদ ও ড্রোন ব্যবহারের সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে না। এসব ঠেকাতে নিরাপত্তা বাহিনীসহ সরকারের সব সংস্থা একযোগে কাজ করছে।
এনবিআর সূত্র জানায়, বন্দরগুলোতে পণ্য খালাসে বিশেষ সফটওয়্যার ব্যবহার করা হয়। প্রতিটি কর্মকর্তার জন্য আলাদা পাসওয়ার্ড নির্ধারিত থাকে। এসব পাসওয়ার্ড যেন কোনোভাবেই হ্যাক না হয়, সে বিষয়েও সতর্কতা জোরদার করা হয়েছে। সম্প্রতি চট্টগ্রাম বন্দরের এক কর্মকর্তার পাসওয়ার্ড চুরি করে বিশেষ কৌশলে পণ্য খালাসের চেষ্টা করা হয়েছিল।
আরও জানা যায়, নাশকতামূলক পণ্য, জরুরি ওষুধ কিংবা তৈরি পোশাক খাতের কাঁচামাল আনার ক্ষেত্রে নামিদামি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও বড় প্রতিষ্ঠানের নাম ব্যবহার করা হচ্ছে। কিছু ক্ষেত্রে মিথ্যা ঘোষণায় জাল বিদেশি মুদ্রাও আনা হচ্ছে। প্যাকেট বা কনটেইনারের বাইরে থেকে অনেক সময় ভেতরের পণ্য বোঝা যায় না। তাই সামান্য সন্দেহ হলেই কার্টন, কনটেইনার ও প্যাকেট খুলে যাচাই করে পণ্য ছাড় করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
লোকবল সংকট ও সব বন্দরে পূর্ণাঙ্গ অটোমেশন না থাকায় আগে অনেক ক্ষেত্রে কাগজপত্রের ওপর নির্ভর করেই পণ্য ছাড় করা হতো। এখন থেকে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই পণ্য খুলে সরেজমিন যাচাই করে ছাড় দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এনবিআর।

