তপশিল ঘোষণার ছয় দিন পেরিয়ে গেলেও নির্বাচন কমিশন (ইসি) এখনো পুরোপুরি প্রস্তুত—এমন দৃশ্য চোখে পড়ছে না। নতুন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন প্রক্রিয়া শেষ হয়নি, আসনভিত্তিক ভোটার তালিকার সিডি তৈরির কাজ চলছে, আর নির্বাচন পরিচালনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দলিল—ম্যানুয়েল—এখনো ছাপা হয়নি। অথচ নভেম্বরের শেষ দিক থেকেই ইসির শীর্ষ কর্মকর্তারা বলে আসছিলেন, নির্বাচনের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন।
বাস্তবতা বলছে, তপশিলের পরপরই যেসব পরিপত্র জারি করার কথা ছিল, সেগুলো দিতে গিয়েই কমিশনকে হিমশিম খেতে হয়েছে। এমনকি প্রার্থীর যোগ্যতা ও অযোগ্যতা–সংক্রান্ত একটি পরিপত্র জারি করার মাত্র দুই দিনের মাথায় তা সংশোধন করতে হয়েছে। শুরুতে গণভোটের অধ্যাদেশের আলোকে সিদ্ধান্তের কথা জানালেও পরে সেখান থেকেও সরে আসে কমিশন।
বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, এই অগোছালো প্রস্তুতির প্রভাব শেষ পর্যন্ত মাঠ প্রশাসন ও ভোটকেন্দ্রে গিয়ে পড়তে পারে। বিশেষ করে একই দিনে সংসদ নির্বাচন ও গণভোট আয়োজন এবং দুই ধরনের ব্যালট গণনা—সব মিলিয়ে পরিস্থিতি জটিল হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।
ইসি সচিবালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, উপদেষ্টা পরিষদ থেকে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধনের সিদ্ধান্ত আসতে দেরি হয়েছে। তার ওপর তপশিল ঘোষণার আগমুহূর্তে বাগেরহাট ও গাজীপুরের আসন সীমানা নিয়ে আদালতের রায় আসে। পরে ফরিদপুর-৪ আসন নিয়েও নতুন রায় হয়। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে সচিবালয়ের অভ্যন্তরীণ জটিলতা। সব মিলিয়ে প্রস্তুতিতে গতি কমেছে বলে স্বীকার করছেন কর্মকর্তারা।
তবে ইসির ভাষ্য, এসব সমস্যা দ্রুত কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা চলছে।
তপশিল ঘোষণার পর থেকেই মনোনয়নপত্র সংগ্রহের সুযোগ দেওয়া হলেও কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরে দেওয়া হয়েছে। ১১ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় প্রধান নির্বাচন কমিশনার জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিলেও, রিটার্নিং কর্মকর্তাদের পরিচয় ও দপ্তরসংক্রান্ত পরিপত্র জারি হয় রাত সাড়ে ১০টার পর।
এ ছাড়া নির্বাচন পরিচালনার নির্দেশনামূলক ম্যানুয়েল, যা প্রশাসন, প্রার্থী, রাজনৈতিক দল, পর্যবেক্ষক ও সাংবাদিকদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ—সেটিও এখনো ছাপা হয়নি। এই ম্যানুয়েলেই থাকে নির্বাচন কীভাবে, কখন, কার মাধ্যমে এবং কোন নিয়মে হবে—তার পূর্ণ নির্দেশনা।
বাংলাদেশে আগে গণভোট হলেও সংসদ নির্বাচনের দিন একই সঙ্গে গণভোট আয়োজনের নজির নেই। এবার প্রবাসী ভোটসহ প্রায় ১৩ কোটি ভোটার একই দিনে দুটি ভোট দেবেন। এতে ভোটকেন্দ্রে দীর্ঘ লাইন, ভোটগ্রহণে সময় বৃদ্ধি এবং ফল ঘোষণায় বিলম্ব—সব কিছুরই আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা।
ইসির করা মক ভোটে দেখা গেছে, একজন ভোটারকে দুটি ভোট দিতে চার থেকে পাঁচ মিনিট সময় লাগছে। এতে কেন্দ্রগুলোর চাপ বাড়তে পারে।
নির্বাচন বিশ্লেষক জেসমিন টুলি মনে করেন, এই কমিশনের বড় কোনো নির্বাচন পরিচালনার অভিজ্ঞতা নেই। তাঁর মতে, স্থানীয় সরকার পর্যায়ের অন্তত কিছু নির্বাচন হলে মাঠের বাস্তবতা বোঝা সহজ হতো। সংসদ নির্বাচন মানেই ক্ষমতার প্রশ্ন—এখানে প্রার্থী ও সমর্থকদের উত্তেজনা অনেক বেশি থাকে।
তিনি আরও বলেন, সংসদ নির্বাচন ও গণভোটের ব্যালট আলাদা বাক্সে রাখা গেলে জট কম হতো। কারণ ভোট শেষে দুই ব্যালট আলাদা করতে গিয়েই সময় ও উত্তেজনা বাড়তে পারে।
নির্বাচন কমিশনার আবদুর রহমানেল মাছউদ জানিয়েছেন, দুই ভোটের ব্যালট একই সঙ্গে গণনা করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। কোনো কেন্দ্রেই একটির আগে আরেকটি গণনার সুযোগ রাখা হয়নি। তিনি বলেন, গণনায় যে সময় লাগবে, সেটুকু সময় প্রার্থী ও সমর্থকদের ধৈর্য ধরতেই হবে।
নতুন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন নিয়েও প্রশ্নের মুখে ইসি। চূড়ান্তভাবে নামঞ্জুরের পর সাতটি দলের আবেদন পুনর্বিবেচনার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় আইন ও বিধিমালার প্রয়োগ নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে।
ইসি সচিব বলছেন, কমিশন ‘ইনহেরেন্ট পাওয়ার’ প্রয়োগ করছে। তবে আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, আরপিওর বাইরে গিয়ে এমন ক্ষমতা প্রয়োগের সুযোগ নেই। অন্যদিকে, নির্বাচন কমিশনার বলছেন—এটি সহজাত ক্ষমতার বিষয় নয়; বরং আদালতের আগের নির্দেশনার আলোকে সহানুভূতির সঙ্গে বিবেচনা করা হচ্ছে।
এই সাতটি দলের মধ্যে রয়েছে—আমজনতার দল, জনতার দলসহ কয়েকটি সংগঠন। মাঠপর্যায়ে যাচাই শেষে দু’টি দলের নিবন্ধন নিয়ে দাবি-আপত্তি আহ্বান করেছে ইসি।
সংসদ নির্বাচন ও গণভোট একসঙ্গে হওয়ায় প্রায় ২০ শতাংশ বাড়তি খরচ লাগবে বলে ইসি জানিয়েছিল। তবে এখনো অর্থ মন্ত্রণালয় কোনো আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব পায়নি।
এদিকে আসন সীমানা পুনর্নির্ধারণ নিয়েও একের পর এক মামলায় হেরেছে ইসি। বাগেরহাট, গাজীপুর ও ফরিদপুরের সীমানা নিয়ে আদালতের রায়ে কমিশনের সিদ্ধান্ত বাতিল হয়েছে। আরও কয়েকটি মামলা উচ্চ আদালতে ঝুলে আছে। যদিও শুনানি শিগগির হওয়ার সম্ভাবনা কম।
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার সতর্ক করে বলেছেন, প্রস্তুতির ঘাটতি দ্রুত পূরণ না হলে এর প্রভাব মাঠ প্রশাসনে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে নিয়ে যেতে পারে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়েও তিনি ইসির ভূমিকার সমালোচনা করেছেন।
সব মিলিয়ে, নির্বাচন সামনে রেখে কমিশনের প্রস্তুতির দাবি ও বাস্তব চিত্রের মধ্যে যে ফাঁক তৈরি হয়েছে, তা দ্রুত না মিটলে নির্বাচন ব্যবস্থাপনাই বড় চ্যালেঞ্জে পড়তে পারে

