বাংলাদেশ ব্যাংক এখন আর খেলাপি ঋণের প্রকৃত তথ্য নিয়মিতভাবে প্রকাশ করছে না। প্রতি প্রান্তিক শেষে যে তথ্য সাধারণত দেড়-দুই মাসের মধ্যে প্রকাশ করা হতো, তা এখন তিন মাসের বেশি বিলম্বে বা একেবারেই প্রকাশ করা হচ্ছে না।
বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারও ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের মতো খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র গোপন করছে—তবে উদ্দেশ্য আলাদা।
আওয়ামী লীগ সরকার তথ্য গোপন করেছিল লুটপাটের কারণে বেড়ে যাওয়া খেলাপি ঋণের প্রকৃত অবস্থা আড়াল করতে। অন্যদিকে, বর্তমান সরকার আশঙ্কা করছে—আওয়ামী আমলের সেই লুটপাটের প্রভাবে খেলাপি ঋণ বাড়ার চিত্র প্রকাশিত হলে আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের আর্থিক ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এতে ব্যবসা-বাণিজ্যের খরচ বাড়বে এবং দেশের ঋণমান (ক্রেডিট রেটিং) আরও নিচে নেমে যেতে পারে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একাধিক প্রতিবেদনের বিশ্লেষণ ও সংশ্লিষ্ট সূত্রের তথ্যে জানা গেছে, জুন প্রান্তিকের খেলাপি ঋণের তথ্য এখনও প্রকাশিত হয়নি, যদিও মার্চ প্রান্তিকের তথ্য প্রকাশ করা হয়েছিল জুনে। এ নিয়ে প্রায় সাড়ে চার মাস পেরিয়ে গেছে।
তবে বিভিন্ন গণমাধ্যম নিজেদের উৎস থেকে তথ্য সংগ্রহ করে জানিয়েছে, দেশের প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ ইতিমধ্যেই সাড়ে ছয় লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিভিন্ন বিভাগ এই হালনাগাদ তথ্য ব্যবহার করলেও তা প্রকাশ করছে না। ব্যাংক খাতের মূলধন ঘাটতি, প্রভিশন ঘাটতি, মূলধন পর্যাপ্ততা, প্রকৃত আয় ও তারল্য পরিস্থিতি নিরূপণের ক্ষেত্রেও এই গোপন তথ্যই ব্যবহার হচ্ছে।
সব মিলিয়ে ব্যাংক খাতের প্রকৃত চিত্র এখন শুধুমাত্র অভ্যন্তরীণ নথিতে সীমাবদ্ধ, যা দেশের অর্থনৈতিক স্বচ্ছতার প্রশ্নে নতুন উদ্বেগ তৈরি করেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক নিয়মিতভাবে ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে প্রকাশ করে ‘বাংলাদেশ ব্যাংক কোয়ার্টারলি’ ও ‘আর্থিক স্থিতিশীলতা মূল্যায়ন প্রতিবেদন। এসব প্রতিবেদনে খেলাপি ঋণসহ ব্যাংক খাতের নানা সূচকের তথ্য বিশ্লেষণ করে প্রকাশ করা হয়। তবে সাম্প্রতিক দুটি প্রতিবেদনে দেখা গেছে—খেলাপি ঋণের হালনাগাদ তথ্য গোপন রাখা হয়েছে।
গত রোববার প্রকাশিত বাংলাদেশ ব্যাংক কোয়ার্টারলি প্রতিবেদন জুন পর্যন্ত সময়ের ভিত্তিতে তৈরি হলেও এতে খেলাপি ঋণের নতুন কোনো তথ্য নেই। বরং প্রতিবেদনে মার্চ প্রান্তিকের পুরোনো তথ্যই ব্যবহার করা হয়েছে। অথচ নিয়ম অনুযায়ী এখানে জুনের তথ্য থাকার কথা ছিল।
একই প্রবণতা দেখা গেছে এর আগের প্রকাশনাতেও। গত জুনে প্রকাশিত প্রতিবেদনেও মার্চ প্রান্তিকের তথ্যই অন্তর্ভুক্ত ছিল। ফলে ধারাবাহিকভাবে দুই প্রান্তিক ধরে খেলাপি ঋণের হালনাগাদ তথ্য আড়াল করা হয়েছে, যা ব্যাংক খাতের প্রকৃত পরিস্থিতি বিশ্লেষণে বড় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে।
সূত্র জানায়, কেন্দ্রীয় ব্যাংক এসব তথ্য ব্যবহার করে ব্যাংক খাতের মূলধন ঘাটতি, প্রভিশন সংরক্ষণ, প্রভিশন ঘাটতি, ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদ ও মূলধন পর্যাপ্ততার মতো গুরুত্বপূর্ণ সূচক মূল্যায়ন করে। কিন্তু হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ না করায় এই মূল্যায়ন প্রক্রিয়া এখন আংশিকভাবে সম্পন্ন হচ্ছে।
এমনকি গত মঙ্গলবার প্রকাশিত ‘আর্থিক স্থিতিশীলতা মূল্যায়ন প্রতিবেদন’-এও একই চিত্র দেখা গেছে। এটি জুন পর্যন্ত সময়ের জন্য হলেও খেলাপি ঋণের তথ্য সেখানে দেওয়া হয়েছে মার্চ পর্যন্ত। প্রতিবেদনে জুনের খেলাপি ঋণের বিশ্লেষণী উপাত্ত পুরোপুরি আড়াল করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, গত জুনে প্রকাশিত প্রতিবেদনে যে খেলাপি ঋণের তথ্য দেওয়া হয়েছিল, সেটিও তৈরি হয়েছিল মার্চের তথ্যের ভিত্তিতে। অর্থাৎ টানা তিন প্রান্তিক ধরে বাংলাদেশ ব্যাংক নতুন তথ্য প্রকাশ না করে পুরোনো তথ্যের পুনরাবৃত্তি করছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, খেলাপি ঋণের হালনাগাদ তথ্য গোপন থাকলে ব্যাংক খাতের স্থিতিশীলতা মূল্যায়নে স্বচ্ছতা নষ্ট হয়। এতে নীতিনির্ধারণ, ঝুঁকি মূল্যায়ন এবং বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত—সব ক্ষেত্রেই নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক কোয়ার্টারলি প্রতিবেদন-এ বড় ধরনের গোপনীয়তা দেখা গেছে। প্রতিবেদনের ১০ ও ১২ নম্বর পৃষ্ঠায় সাধারণত শীর্ষ ৫ ও শীর্ষ ১০ ব্যাংকের সম্পদ ও খেলাপি ঋণ পুঞ্জীভূত হওয়ার চিত্র গ্রাফ আকারে প্রকাশ করা হয়। কিন্তু এবারের প্রতিবেদনে কেবল সম্পদের তথ্যই প্রকাশ করা হয়েছে; খেলাপি ঋণের গ্রাফ পুরোপুরি বাদ দেওয়া হয়েছে।
তবে প্রতিবেদনে ব্যাংকগুলোর আয়, মূলধন ও ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে—যদিও খেলাপি ঋণের আপডেট তথ্য আড়াল করে এই তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক কর্মকর্তা জানান, খেলাপি ঋণের হালনাগাদ তথ্য তৈরি করে সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোকে সরবরাহ করা হয়েছে। এসব বিভাগ গবেষণা ও বিশ্লেষণের কাজে তা ব্যবহার করছে। তবে তথ্যগুলো সাধারণের জন্য প্রকাশ করা হয়নি। কর্মকর্তা বলেন, “কিছু আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে পরে তা প্রকাশ করা হবে।”
খেলাপি ঋণ বাড়ছে উদ্বেগজনক হারে:
সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ব্যাংক খাতের লুটপাটের কারণে খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র গোপন রাখা হতো, যাতে সেই লুটপাটের প্রমাণ আড়ালে থাকে। তবে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার শুরুতে সব খাতের প্রকৃত তথ্য প্রকাশ করতে থাকে। খেলাপি ঋণের তথ্যও তখন প্রকাশ্যে আসতে শুরু করে।
কিন্তু এখন আবার সেই স্বচ্ছতার ধারায় ভাটা পড়েছে। খেলাপি ঋণের পরিমাণ দ্রুত বেড়ে যাওয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক নতুন তথ্য প্রকাশে পিছিয়ে গেছে।
গত বছরের জুনে (২০২৪) ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ২ লাখ ১১ হাজার কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশ। এরপর ২০২৫ সালের মার্চ নাগাদ তা বেড়ে দাঁড়ায় ৪ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা, অর্থাৎ মোট ঋণের ২৪ দশমিক ১৩ শতাংশ।
অর্থাৎ মাত্র নয় মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২ লাখ ৯ হাজার কোটি টাকা। সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্যে দেখা গেছে, ২০২৫ সালের জুনে খেলাপি ঋণ সাড়ে ছয় লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। অর্থাৎ ঋণখেলাপির পরিমাণ এখন অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় বেশি।
অর্থনীতিবিদদের মতে, খেলাপি ঋণ বাড়ার প্রবণতা কমাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিশেষ ছাড় ও পুনঃতফসিলের সুবিধা দিচ্ছে, যাতে পরিসংখ্যানগতভাবে ঋণখেলাপির পরিমাণ কিছুটা কম দেখানো যায়। তবে এতে প্রকৃত সমস্যা আড়াল হচ্ছে, সমাধান নয়।
বাংলাদেশে খেলাপি ঋণের হার এখন দক্ষিণ এশিয়াসহ বহু দেশের তুলনায় সর্বোচ্চ। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত নিরাপদ সীমা যেখানে ৩ শতাংশ, সেখানে বাংলাদেশের খেলাপি ঋণের হার ৩০ শতাংশেরও বেশি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই অস্বাভাবিক হার আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের ব্যাংক খাত সম্পর্কে নেতিবাচক বার্তা দিচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজারে ঝুঁকিপূর্ণ ব্যাংকের সঙ্গে বড় ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো লেনদেন করতে চায় না। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে বাংলাদেশি ব্যাংকের সঙ্গে লেনদেন করতে হলে তৃতীয় পক্ষের গ্যারান্টি দিতে হয়।
এই গ্যারান্টি বাবদ অতিরিক্ত ফি বা কমিশন পরিশোধ করতে হয়, যা বৈদেশিক বাণিজ্যের খরচ বাড়িয়ে দিচ্ছে। এর ফলে আমদানি-রপ্তানি খাতে প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান দুর্বল হচ্ছে।
অর্থনীতিবিদদের মতে, উচ্চ খেলাপি ঋণের কারণে বাংলাদেশের ঋণমান (ক্রেডিট রেটিং) নিচের দিকে নামছে। এতে আন্তর্জাতিকভাবে ঋণ পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ছে এবং সুদের হারও বেড়ে যাচ্ছে।
এই পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক খেলাপি ঋণ কমাতে জোর পদক্ষেপ নিয়েছে। বিশেষ ছাড়, পুনঃতফসিল ও ঘনিষ্ঠ নজরদারি চালুর মাধ্যমে ব্যাংকগুলোর চাপ কমানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
তবে অর্থনীতিবিদদের মতে, এসব পদক্ষেপে সাময়িক স্বস্তি মিললেও কাঠামোগত সংস্কার ছাড়া খেলাপি ঋণের প্রবণতা কমবে না। স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও কার্যকর আইনি প্রক্রিয়া ছাড়া ব্যাংক খাতের এই গভীর সংকট থেকে উত্তরণ কঠিন।

