দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য, নির্মাণ ও পরিবহনসহ প্রায় সব উৎপাদনমুখী খাতে ব্যাংক ঋণ বিতরণ কমেছে। এর প্রভাব পড়েছে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগে। অর্থনীতির অন্যতম চালিকা শক্তি হিসেবে এই খাত এখন স্থবির হয়ে উঠেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের সেপ্টেম্বর শেষে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি মাত্র ৬.২৯ শতাংশে নেমে এসেছে। এটি গত ২২ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগের মতো সহজে ঋণ পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে সার্বিক অর্থনৈতিক কার্যক্রমও ধীর হয়ে গেছে। মানুষ ও ব্যবসায়ীদের চাহিদা কমেছে। অনেক কারখানা উৎপাদন বন্ধ বা হ্রাস করছে। এর ফলে ঋণ বিতরণ আরও কমছে।
অপরদিকে, বেসরকারি খাতের ঋণে বছরে ১০ শতাংশের বেশি সুদ ধার্য হচ্ছে। এ পরিস্থিতি বিনিয়োগ ও ব্যবসা সম্প্রসারণের পথে নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে।
ঋণ কমেছে যেসব খাতে:
বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, ব্যবসায়ীরা নতুন ঋণ নিচ্ছেন না। পাশাপাশি পুরনো ঋণ পরিশোধের চাপও বাড়ছে। বিশেষ করে নির্মাণ ও ব্যবসা-বাণিজ্য খাতে টানা তিন প্রান্তিক ঋণ কমেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০২৪ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত অধিকাংশ খাতে ঋণের স্থিতি কমেছে। অর্থাৎ বিতরণকৃত ঋণের চেয়ে আদায় বেশি হওয়ায় ঋণের স্থিতি বাড়েনি।
জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিকে কিছু খাতে মেয়াদি ঋণ বেড়েছে, তবে এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে তা হ্রাস পেয়েছে। মার্চে মেয়াদি ঋণের পরিমাণ ছিল ৩ লাখ ৮৫ হাজার ৯০০ কোটি টাকা, যা জুনে কমে ৩ লাখ ৮১ হাজার ৩০০ কোটি টাকায় নেমেছে। এর মানে, এখন নতুন প্রকল্প গ্রহণ খুবই সীমিত। মেয়াদি ঋণ মূলত নতুন প্রকল্পের জন্য নেওয়া হয়।
নির্মাণ ও ব্যবসা-বাণিজ্য খাতে টানা তিন প্রান্তিক ঋণ কমে আসছে। পরিবহন খাতেও নতুন বিনিয়োগ নেই, বরং ঋণ কমেছে। নির্মাণ খাতের ঋণ ধারাবাহিকভাবে হ্রাস পাচ্ছে। গত বছরের ডিসেম্বরের সময় এই খাতে ঋণের স্থিতি ছিল ১ লাখ ২৪ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। মার্চে কমে ১ লাখ ২২ হাজার ৭০০ কোটি টাকায় নেমে যায়, আর জুনে আরও কমে ১ লাখ ২১ হাজার ৫০০ কোটি টাকায় দাঁড়ায়। সরকারি ও বেসরকারি উভয় খাতেই নির্মাণ কার্যক্রমে ভাটা পড়েছে। এর ফলে রড-সিমেন্টের দাম ও বিক্রিও কমেছে।
পরিবহন খাতেও নতুন বিনিয়োগ নেই। মার্চ থেকে জুনের মধ্যে ঋণ কমেছে ১০০ কোটি টাকা। ব্যবসা-বাণিজ্য খাতের চিত্রও একই রকম। ডিসেম্বরে ঋণ ছিল ৫ লাখ ৩৩ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। মার্চে এটি বেড়ে ৫ লাখ ৫০ হাজার ৮০০ কোটি টাকায় পৌঁছালেও জুনে কমে ৫ লাখ ৪৬ হাজার ৫০০ কোটি টাকায় নেমে গেছে।
কেন ঋণ কমছে:
ঋণ বিতরণ কমছে, তেমনি খেলাপি ঋণের পরিমাণও বাড়ছে। এতে ব্যাংকগুলোর কাছে ঋণ দেওয়ার তহবিল সংকুচিত হচ্ছে। বাংলাদেশে ২০২৫ সালের জুন মাসের শেষ পর্যন্ত খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ ৩০ হাজার ৪২৮ কোটি টাকায়। এটি বিতরণকৃত মোট ঋণের ২৭.০৯ শতাংশ। এক বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩ লাখ কোটি টাকার বেশি।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সাবেক সভাপতি ও এ কে খান অ্যান্ড কোম্পানির পরিচালক আবুল কাসেম খান বলেন, “অর্থনীতির গতি বেশ আগেই কমে গেছে। সে জায়গা থেকে বের হওয়া সম্ভব হয়নি। রপ্তানি খাত আগের মতোই আছে, তবে মূল্যস্ফীতি প্রত্যাশা অনুযায়ী কমেনি। মানুষের চাহিদা কমেছে। নির্বাচন কবে হবে, সেটা নিয়েও সবাই অপেক্ষা করছে। আগের মতো ভুয়া ঋণও বিতরণ হচ্ছে না। এটাই ঋণ কমার একটি কারণ।”
তিনি আরও যোগ করেন, “আমরা চাই খরচ বাড়ুক। সরকারি ও বেসরকারি খাতে এটি কর্মসংস্থান বাড়াবে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করবে। তবে এখন তা হচ্ছে না। অনেকেই পরিস্থিতি অনুযায়ী প্রস্তুতি নিচ্ছে। ভালো নির্বাচনের পর সরকার এলেই বিনিয়োগ শুরু হবে।”
একাধিক ব্যাংকের ঋণ বিভাগের কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়ন কমেছে। ফলে রড-সিমেন্ট বিক্রি কমেছে। সরকারি ও বেসরকারি প্রায় ২৫টি ব্যাংক ব্যবসা-বাণিজ্যে ঋণ দেওয়া বন্ধ রেখেছে। তাই নতুন ঋণ খুব সীমিত।
তারা বলছেন, “নির্বাচন হয়ে গেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে, বিষয়টা এত সহজ নয়। ঋণ যারা দেবে, তাদের কাছে ঋণযোগ্য তহবিল কম। তাই পরিস্থিতি এখনও চাপের মধ্যে আছে।”

