দেশের সবচেয়ে বড় ঋণদাতা ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড (আইবিবিএল) এখন ব্যালান্সশিটে এক বিশাল গর্তের মুখোমুখি। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকের প্রভিশন বা নিরাপত্তা সঞ্চিতির ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৮৫ হাজার ৮৮৮ কোটি টাকা।
ব্যালান্সশিট ঘাটতি পূরণের জন্য ব্যাংক ১৫ অক্টোবর বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে আবেদন করে। সরকারের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ইতোমধ্যেই ২০ বছরের ডেফারাল সুবিধা অনুমোদন করেছে। অর্থাৎ ঘাটতি ধাপে ধাপে মেটানোর সুযোগ মিলেছে। আইবিবিএল আবেদনের সঙ্গে একটি কর্মপরিকল্পনা জমা দিয়েছে। সেখানে ব্যাংক ঘাটতি মোকাবিলায় কৌশল ও প্রস্তাবিত পদক্ষেপ তুলে ধরেছে। তবে ঘাটতির পরিমাণ এত বিশাল যে বিশেষজ্ঞদের প্রশ্ন, যদি ব্যাংকের সবচেয়ে বড় ঋণগ্রহীতা, বিশেষ করে এস আলম গ্রুপ থেকে ঋণ আদায় না হয়, তাহলে ব্যাংক এই ঘাটতি পূরণ করতে কত বছর লাগবে।
ঋণের অর্থ পুনরুদ্ধারে প্রতিকূলতা ইতোমধ্যেই দেখা যাচ্ছে। ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড (আইবিবিএল) এস আলম গ্রুপের কিছু সম্পত্তি জব্দ করলেও নিলামে ক্রেতা পাচ্ছে না। এটি ভবিষ্যতের কঠিন বাস্তবতার ইঙ্গিত দেয়। গত কয়েক বছর ব্যাংক সামান্য হলেও মুনাফা রাখতে সক্ষম হয়েছে। বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে নিট মুনাফা ছিল ৬১৬ কোটি টাকা, ২০২৩ সালে ৬৩৫ কোটি টাকা। মহামারির আগে ২০১৮ ও ২০১৯ সালে মুনাফা বছরে প্রায় ৬০০ কোটি টাকার কাছাকাছি।
ধরা যাক, ব্যাংক সব মুনাফা প্রভিশন ঘাটতি পূরণে ব্যবহার করে—কোনো ডিভিডেন্ড বা লভ্যাংশ না দিয়ে, পুনঃবিনিয়োগ না করে বা কোনো লিকেজ ছাড়াই। তবুও গড় ৬০০ কোটি টাকা বার্ষিক মুনাফা ধরে রাখলে ঘাটতি পূরণে লাগবে ১৪৩ বছর। যা এক মানবজীবনের চেয়েও বেশি, এমনকি ব্যাংকের অস্তিত্বকালের তিন গুণ।
চলতি বছরের পারফরম্যান্স ধরে নিলে চিত্র আরও হতাশাজনক। ৯ মাসে সমন্বিত নিট মুনাফা দাঁড়িয়েছে মাত্র ৯৯.৭৭ কোটি টাকা। পুরো বছর হিসাব করলে সম্ভাব্য নিট মুনাফা হতে পারে প্রায় ১৩৩ কোটি টাকা। এই হার ধরে গেলে ঘাটতি পূরণে সময় লাগবে ৬৪৫ বছর। অত্যন্ত আশাবাদী হিসাবও ধরা যাক—যদি ২০২৫ সাল থেকে প্রতি বছর নিট মুনাফা ১৫ শতাংশ কম্পাউন্ড হারে বাড়ে। তবুও প্রভিশন ঘাটতি পূরণ করতে লাগবে প্রায় ৩৫ বছর। এখানে ধরে নেওয়া হয়েছে আর কোনো নতুন ঘাটতি হবে না।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের সাবেক মহাপরিচালক তৌফিক আহমদ চৌধুরী বলেন, “মুনাফা অর্জন করেই ইসলামী ব্যাংকের ঘাটতি পূরণ করা অসম্ভব।” তিনি বলেন, ব্যাংক বাঁচানোর উপায় দুটি—ঋণ পুনরুদ্ধার বা নতুন তহবিল। তবে নতুন তহবিল স্পনসরদের পক্ষে প্রায় অসম্ভব। “সরকারকে বাজেট থেকে অর্থ বরাদ্দ দিতে হবে।”
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, প্রভিশনের ঘাটতি শুধু একটি সংখ্যা নয়। এটি দীর্ঘদিনের অব্যবস্থাপনা, ঝুঁকিপূর্ণ ঋণ বিতরণ এবং নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের দুর্বলতার প্রতিফলন। “৮৬ হাজার কোটি টাকার ঘাটতি উদ্বেগজনক। নীতিগত হস্তক্ষেপ এবং নতুন মূলধন জরুরি।” তিনি সতর্ক করে বলেন, সরকারি তহবিল দিয়ে পুনঃমূলধনীকরণের অতীত ভালো হয়নি। এছাড়া ১৫ শতাংশ যৌগিক মুনাফা বৃদ্ধির আশায় ঘাটতি পূরণ করা দীর্ঘমেয়াদে কঠিন। “ধরে নিলেও পূরণে লাগবে ৩৫ বছর।”
এত বড় ঘাটতির পরও ইসলামী ব্যাংকে আমানতকারীদের সীমাবদ্ধতা আরোপ করা হয়নি। ব্যাংকের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানান, জানুয়ারি–সেপ্টেম্বর সময়ে নেট আমানত এসেছে ১৯ হাজার কোটি টাকা। কোনো তারল্য ঘাটতি নেই এবং কোনো আমানতকারীকে টাকা দেওয়ার ক্ষেত্রে সমস্যা হয়নি। তিনি বলেন, এত বেশি আমানত আসায় সুদহার কমানো হয়েছে। রেমিট্যান্সও বেড়েছে। তবে তিনি সতর্ক করে বলেন, সরকারি সহায়তা না পেলে ব্যাংকের টিকে থাকা কঠিন হবে। “জামানত বিক্রি করে ঋণ সমন্বয় চেষ্টা করছি, কিন্তু সব ঘাটতি পূরণ সম্ভব নয়।”
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রভিশন ঘাটতি ব্যাংকের প্রকৃত দুর্বলতা প্রকাশ করে। পর্যাপ্ত প্রভিশন না থাকলে সম্ভাব্য ক্ষতি স্বীকৃত হয় না। এতে কাগজে মুনাফা বাড়লেও সম্পদের মান কমে যায় এবং নিয়ন্ত্রক ও আমানতকারীরা ভুল তথ্য পান। বড় প্রভিশন ঘাটতি মূলধন কমায়, ঋণ দেওয়ার ক্ষমতা দুর্বল করে এবং দেউলিয়াত্বের ঝুঁকি বাড়ায়।
আইবিবিএল–এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক যা বলছেন:
ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ওমর ফারুক খান স্বীকার করেন, শুধুমাত্র মুনাফা ব্যবহার করে এত বড় ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব নয়। তিনি বলেন, “আমাদের প্রভিশন রিকয়্যারমেন্ট কমাতে হবে।” তিনি জানান, ব্যাংকের প্রায় অর্ধেক বিনিয়োগ পোর্টফোলিও বর্তমানে শ্রেণিকৃত। এটিকে ধীরে ধীরে নামিয়ে আনার পরিকল্পনা রয়েছে। “আমরা নন-পারফর্মিং লোন বা মন্দ ঋণ পুনরুদ্ধারকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিচ্ছি,” যোগ করেন তিনি।
ওমর ফারুক আরও জানান, এই প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে নিলামে ক্রেতা না পাওয়ায় ইসলামী ব্যাংক ইতোমধ্যে এস আলম গ্রুপের প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা মূল্যের সম্পত্তি জব্দ করেছে। “আমরা বিদ্যমান গ্রাহকদের রেটিং করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি, যা প্রভিশনের প্রয়োজন কমাতে সাহায্য করবে। আমরা আত্মবিশ্বাসী—২০ বছরের মধ্যেই এই ঘাটতি সামলানো সম্ভব হবে।”
আইবিবিএল ও একীভূত ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতির চিত্র:
আগস্ট ২০২৫ পর্যন্ত একীভূত হতে যাওয়া পাঁচ ব্যাংকের সম্মিলিত প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকার বেশি। ব্যাংকভিত্তিক অবস্থান অনুযায়ী:
- ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক: ৫৩,৮৯০ কোটি টাকা
- সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক: ২৪,৮৪৫ কোটি টাকা
- ইউনিয়ন ব্যাংক: ২৩,৮১১ কোটি টাকা
- এক্সিম ব্যাংক: ২০,৫৫৮ কোটি টাকা
- গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক: ১২,১২৪ কোটি টাকা
এদিকে, ইসলামী ব্যাংকের নিজস্ব প্রভিশন ঘাটতি এ বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৫,৮৮৮ কোটি টাকায়। এর মধ্যে বিনিয়োগের জন্য প্রয়োজন ৮২,১৮৬ কোটি টাকা এবং অফ–ব্যালান্স শিট আইটেমের জন্য ৩,৭০২ কোটি টাকা। ইসলামী ব্যাংকের তৃতীয় প্রান্তিকের প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ডিসেম্বরের তুলনায় সেপ্টেম্বর ২০২৫–এ প্রভিশনের প্রয়োজনীয়তা মাত্র ৯ মাসে আরও ১৬,১২৫ কোটি টাকা বেড়েছে।
আইবিবিএল ২০ বছরে প্রভিশন ঘাটতি পূরণের আবেদন:
ইসলামী ব্যাংকের পরিচালন আয়ের প্রায় ৯১ শতাংশ ইতোমধ্যেই পরিচালন ব্যয়ে চলে যাচ্ছে। এটি স্পষ্ট করে দেয়, এত বিশাল প্রভিশন ঘাটতি পূরণ করা ব্যাংকের পক্ষে স্বাভাবিক উপায়ে সম্ভব নয়। ২০২৫ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়কালে, ব্যাংকের মোট পরিচালন ব্যয় ছিল ২ হাজার ৭৯৪ কোটি টাকা, আর পরিচালন আয় ৩ হাজার ৭৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ পরিচালন আয়ের ৯০.৯ শতাংশই খরচ হয়ে গেছে। ফলে প্রভিশনের আগে মুনাফা থাকে মাত্র ৯.১ শতাংশ বা প্রায় ২৭৯ কোটি টাকা।
ইসলামী ব্যাংক ১৫ অক্টোবর বাংলাদেশ ব্যাংকে চিঠি দিয়ে ২০ বছরের ডেফারাল সুবিধা চেয়েছিল। অভ্যন্তরীণ সূত্রের খবর অনুযায়ী, এটি অনুমোদিতও হয়েছে। তবে প্রশ্ন থেকে যায়—মাত্র দুই দশকে কি ব্যাংক এই বিশাল ঘাটতি পূরণ করতে পারবে? ব্যাংকের তৃতীয় প্রান্তিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুসারে, চলতি বছরের ৯ মাসে প্রভিশনের প্রয়োজন বেড়েছে ১৬ হাজার কোটি টাকার বেশি। কিন্তু একই সময়ে বিনিয়োগ ও অফ–ব্যালান্সশিট আইটেমের জন্য ব্যাংক রাখতে পেরেছে মাত্র ২৭ কোটি টাকা। ব্যাংক আশা করছে, বছর শেষে প্রভিশনের পরিমাণ বাড়ানো সম্ভব হবে।
কীভাবে তৈরি হলো ইসলামী ব্যাংকের অপূরণীয় ক্ষতি:
নেপথ্যে কিছু সমস্যা থাকলেও ২০১৬ পর্যন্ত ইসলামী ব্যাংক তুলনামূলকভাবে ভালো করছিল। কিন্তু ২০১৭ সালে এস আলম গ্রুপ ব্যাংকটির পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পরপরই পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করে। একই সময়ে মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকজন বিনিয়োগকারী ব্যাংকের শেয়ার বিক্রি করে বেরিয়ে যান।
আইবিবিএলের ২০২৪ সালের প্রতিবেদনে দেখা যায়, এস আলম গ্রুপ ও এর অঙ্গপ্রতিষ্ঠানগুলো ইসলামী ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে ৭৩ হাজার কোটি টাকার বেশি। এটি ব্যাংকের মোট ঋণ পোর্টফোলিওর প্রায় ৫০ শতাংশ। কিন্তু এসব ঋণের বিপরীতে বন্ধক রাখা সম্পদের মূল্য মাত্র ৪,৩৫৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ ব্যাংকের প্রতি ১৭ টাকা ঋণের বিপরীতে জামানত আছে মাত্র ১ টাকা।
অনেক ঋণ ব্যাংকিংয়ের মৌলিক নীতিমালা ভঙ্গ করে দেওয়া হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, চট্টগ্রামের লোকসানী আটা কল সিলভার ফুড ইন্ডাস্ট্রিজ ২০২২ সালের মাঝামাঝি ১৮ কোটি টাকায় কিনে নেন এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলম (মাসুদ)। ২০২৩ সালের ৬ এপ্রিল ইসলামী ব্যাংকের আন্দরকিল্লা শাখা এই মিলের নামে ৮৫০ কোটি টাকার ঋণ অনুমোদন দেয়, যা পরে ১,০০০ কোটি টাকার বেশি হয়েছে।
গত সপ্তাহে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ইসলামী ব্যাংক থেকে প্রভাব ও ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে প্রায় ১০,৫০০ কোটি টাকার ঋণ জালিয়াতি ও আত্মসাতের অভিযোগে এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যানসহ ৬৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এটি দাখিল হলে বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় অর্থ আত্মসাতের মামলা হিসেবে রেকর্ড গড়বে।

