বাংলাদেশে ডিজিটাল আর্থিক সেবা গত এক দশকে চোখে পড়ার মতো অগ্রগতি করেছে। এর মূল চালিকা শক্তি হলো মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস), যা দেশের লাখ লাখ মানুষের দৈনন্দিন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে সহজ করেছে। বর্তমানে দেশে ৯ কোটির বেশি সক্রিয় ব্যবহারকারী প্রতিদিন প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা লেনদেন করছেন এমএফএসের মাধ্যমে।
ইন্টারনেট ব্যাংকিং, কার্ড পেমেন্ট ও অন্যান্য ডিজিটাল চ্যানেলেও উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি দেখা যাচ্ছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক একটি গুরুত্বপূর্ণ সার্কুলার প্রকাশ করেছে। এর মাধ্যমে দেশের যেকোনো ব্যাংক, এমএফএস বা পেমেন্ট সার্ভিস প্রোভাইডার (পিএসপি) অ্যাকাউন্ট থেকে অন্য যেকোনো অ্যাকাউন্টে তাৎক্ষণিক টাকা পাঠানো যাবে। এটি দেশের আর্থিক ব্যবস্থায় যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে এবং ডিজিটাল অর্থনীতির নতুন যুগের সূচনা করবে।
পাশাপাশি প্রতিবেশী দেশগুলোর উদাহরণও দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। ভারতে ক্যাশলেস পেমেন্ট সফল হওয়ার প্রধান কারণ হলো পি টু পি ট্রান্সফার এবং অধিকাংশ কিউআর লেনদেনে কোনো চার্জ না থাকা। পাকিস্তানে পি টু পি ট্রান্সফারে কোনো খরচ নেই এবং সরকার কিউআর পেমেন্ট উৎসাহিত করতে প্রোভাইডারদের লেনদেনে ০.৫ শতাংশ ভর্তুকি দিচ্ছে।
ক্যাশলেস ডিজিটাল লেনদেনের দুটি প্রধান ভিত্তি হলো কুইক রেসপন্স (কিউআর) কোড পেমেন্ট এবং পি টু পি (পারসন টু পারসন) ট্রান্সফার। বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২১ সালে বাংলা কিউআর স্কিমের মাধ্যমে সর্বজনীন কিউআর পেমেন্ট চালু করে। এর ফলে গ্রাহকরা যেকোনো ব্যাংক বা ওয়ালেট অ্যাপ ব্যবহার করে কোডটি স্ক্যান করলেই টাকা তাৎক্ষণিকভাবে প্রাপকের অ্যাকাউন্টে পাঠাতে পারেন। এবার বাংলাদেশ ব্যাংক পারসন টু পারসন ট্রান্সফার কার্যকর করছে। এর মাধ্যমে দেশের যেকোনো অঞ্চল থেকে একজন ব্যবহারকারী সহজেই নিজের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে অন্য অঞ্চলের কারও এমএফএস অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠাতে পারবেন।
বৈশ্বিক অভিজ্ঞতা ও বাংলাদেশে সার্ভিস চার্জের বাস্তবতা:
বাংলাদেশ ক্যাশলেস লেনদেনের ক্ষেত্রে ভারত, শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিতে পারে। ভারত ২০১৬ সালে ইউনিফায়েড পেমেন্ট ইন্টারফেস (ইউপিআই) চালু করে। বর্তমানে এই সিস্টেমে মাসে ১ হাজার ৭০০ কোটি লেনদেন হয়, যা প্রায় ২৮০ বিলিয়ন ডলারের সমমূল্যে। শ্রীলঙ্কা ২০১৮ সালে পি টু পি ট্রান্সফার এবং ২০১৯ সালে কিউআর পেমেন্ট চালু করে। পাকিস্তান ২০২২ সালে রাস্ট ডিজিটাল পেমেন্ট প্ল্যাটফর্ম কার্যকর করে।
ভারতে ক্যাশলেস পেমেন্টের সফলতার মূল কারণ হলো পি টু পি ট্রান্সফার ও অধিকাংশ কিউআর লেনদেনে কোনো চার্জ না থাকা। পাকিস্তানেও পি টু পি ট্রান্সফারে কোনো খরচ নেই। সরকার কিউআর পেমেন্টকে উৎসাহিত করতে প্রোভাইডারদের লেনদেনে ০.৫ শতাংশ ভর্তুকি দিচ্ছে।
বাংলাদেশের বাস্তবতা কিছুটা ভিন্ন। এখানে মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস সবচেয়ে জনপ্রিয়। গ্রাহকরা বিনা খরচে টাকা গ্রহণ করতে পারলেও উত্তোলনের ক্ষেত্রে সার্ভিস চার্জ প্রযোজ্য। এ বাস্তবতা বিবেচনায় বাংলাদেশ ব্যাংক এমএফএস, ব্যাংক ও পেমেন্ট সার্ভিস প্রোভাইডারদের সঙ্গে আলোচনা করে ভারসাম্যপূর্ণ প্রাইসিং কাঠামো নির্ধারণ করেছে। পি টু পি ট্রান্সফারে গ্রাহক সর্বোচ্চ সার্ভিস চার্জ দেবেন এই হার অনুযায়ী:
-
প্রেরক এমএফএস থেকে পাঠালে হাজারে ৮.৫০ টাকা
-
ব্যাংক থেকে পাঠালে হাজারে ১.৫০ টাকা
-
পিএসপি থেকে পাঠালে হাজারে ২ টাকা
কিউআর পেমেন্টে গ্রাহক কোনো চার্জ দেবেন না। তবে মার্চেন্ট লেনদেনে সর্বোচ্চ এমডিআর হবে লেনদেনের ১.১৫ শতাংশ। প্রথমে নিশ্চিত করতে হবে সেবার মান ও নিরবচ্ছিন্ন কার্যকারিতা। প্রতিটি লেনদেন সফলভাবে সম্পন্ন হতে হবে, যাতে ব্যবহারকারীরা আস্থা ও স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। পাশাপাশি সব গ্রাহক ও ব্যবসায়ীদের ডিজিটাল পেমেন্টের সুবিধা সম্পর্কে জানাতে হবে। এই উদ্যোগে সরকার, বাংলাদেশ ব্যাংক এবং সব সার্ভিস প্রোভাইডার একসঙ্গে কাজ করবেন।
ভারত ও পাকিস্তানের মতো প্রণোদনা কার্যক্রমও চালু করা যেতে পারে। বর্তমানে বাংলাদেশ প্রতিবছর প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা ক্যাশ ব্যবস্থাপনায় ব্যয় করে। এর অল্প অংশ (যেমন ৫ শতাংশ বা বছরে এক হাজার কোটি টাকা) ডিজিটাল লেনদেন প্রচারে বিনিয়োগ করলে দীর্ঘ মেয়াদে অর্থনীতিতে বড় ইতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
বাস্তবায়নের জন্য নেতৃত্ব ও কার্যক্রম:
বাংলাদেশ ব্যাংক ডিজিটাল রূপান্তরের নেতৃত্ব দেবে। তবে সফল বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন সমন্বিত প্রচেষ্টা। ব্যাংক, এমএফএস ও পেমেন্ট সার্ভিস প্রোভাইডার—সব অংশীদারকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। এ জন্য একটি কার্যকরী কমিটি গঠন করা যেতে পারে। সার্বক্ষণিক মনিটরিংয়ের মাধ্যমে সেবার মান নিশ্চিত করতে হবে এবং কোনো সমস্যা দেখা দিলে তা দ্রুত সমাধান করতে হবে।
ক্যাশলেস লেনদেন ত্বরান্বিত করতে কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে। বাজারের সব ব্যবসায়ীকে বাংলা কিউআর কোড ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। বিদ্যমান নিজস্ব কিউআর কোড দ্রুত বাংলা কিউআর দিয়ে প্রতিস্থাপন করতে হবে। ট্রেড লাইসেন্সধারী সব দোকানে লাইসেন্সের পাশে কিউআর কোড প্রদর্শন বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে।
দেশের ব্যাংক, এমএফএস ও পিএসপি ব্যবহারকারীদের জন্য কিউআর কোড ইস্যু করা যাবে। এর ফলে একজন গ্রাহক অন্যজনের কিউআর স্ক্যান করে সহজে লেনদেন করতে পারবেন। অল্প সময়ে দেশে ১০ কোটির বেশি কিউআর কোড ইস্যু হবে, যা সচেতনতা ও লেনদেন উভয়ই বাড়াবে। পল্লী বিদ্যুৎসহ সব ইউটিলিটি বিলে কিউআর কোড প্রিন্ট করতে হবে। মেট্রোরেলসহ সব সরকারি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানে কিউআর কোডের মাধ্যমে টিকিট কাটা ও পেমেন্টের ব্যবস্থা চালু করা হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এই ক্যাশলেস লেনদেন উদ্যোগ নগদনির্ভরতা কমাবে এবং আর্থিক অন্তর্ভুক্তিকে শক্তিশালী করবে। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাদের আনুষ্ঠানিক আর্থিক ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত করবে। সঠিক নেতৃত্ব, বাস্তবসম্মত নীতি ও অংশীদারদের সহযোগিতার মাধ্যমে এ উদ্যোগ ডিজিটাল বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির নতুন অধ্যায় রচনা করবে।
ড. শাহাদাত খান: প্রতিষ্ঠাতা, সিইও, টালিখাতা ও টালিপে। সূত্র: প্রথম আলো

