ব্যাংকিং পেশায় ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা নতুন কিছু নয়। এটি এমন এক অদৃশ্য প্রহরী, যার ওপর দাঁড়িয়ে থাকে বিশ্বব্যাপী আর্থিক খাতের আস্থা ও স্থিতি। তবে গত তিন দশকে ঝুঁকির ধরন যেমন বদলেছে, তেমনি বদলেছে এর ব্যবস্থাপনার দর্শনও।
এক সময় ঝুঁকি ব্যবস্থাপক মানেই ছিল নিয়মকানুন মেনে চলা, তদারকি করা এবং ঋণ অনুমোদনের আগে সতর্ক সংকেত দেওয়া। আজকের দিনে সেই ভূমিকা অনেক বিস্তৃত। এখন ঝুঁকি ব্যবস্থাপক কেবল তদারকির দায়িত্ব পালন করেন না। তিনি প্রতিষ্ঠানের কৌশলগত অংশীদার, ব্যবসার সহনির্মাতা এবং আর্থিক স্থিতির রক্ষাকবচ।
আমি যখন ১৯৮০-এর দশকের মাঝামাঝি ব্যাংকিং পেশায় প্রবেশ করি, তখন ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার প্রশিক্ষণই ছিল একজন পেশাদার ব্যাংকার হওয়ার প্রথম ধাপ। এএনজেড গ্রিন্ডলেজ ব্যাংকে আমি প্রথম ঋণ অনুমোদক হিসেবে কাজ শুরু করি ১৯৯২ সালে। পরে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকে ‘ক্রেডিট স্কিলস অ্যাসেসমেন্ট’ (সিএসএ) নামের একটি আন্তর্জাতিক সার্টিফিকেশন সম্পন্ন করি। লন্ডনের ওমেগা ইনস্টিটিউটের তত্ত্বাবধানে ১৪টি মডিউল পাস করার পরই ঝুঁকি ব্যবস্থাপক হিসেবে স্বীকৃতি পাই।
সিটিব্যাংক এনএতে সিনিয়র ক্রেডিট অফিসার হওয়ার আগে কেবল করপোরেট ব্যাংকিং অভিজ্ঞতা যথেষ্ট ছিল না। পাশাপাশি প্রয়োজন ছিল ক্রস-বর্ডার অডিট, করপোরেট ঋণ পুনর্গঠন এবং আন্তর্জাতিক অর্থনীতি ও আর্থিক খাতের গভীর জ্ঞানের। এই অভিজ্ঞতাগুলো আমাকে শিখিয়েছে ব্যাংকিং মানে ঝুঁকির সঙ্গে শান্তিপূর্ণ বসবাস করা। মূলত প্রতিটি ব্যাংকারের সিদ্ধান্তে ঝুঁকি থাকে। তবে দক্ষ ব্যাংকারদের কাছে ঝুঁকি ভয়ঙ্কর নয়। তারা ঝুঁকি বোঝেন, পরিমাপ করেন এবং প্রয়োজনে সেটিকে সুযোগে রূপান্তর করেন। বাণিজ্যিক ব্যাংকের প্রাণ হলো ক্রেডিট রিস্ক বা ঋণ ঝুঁকি। ব্যাংকিং মানেই অন্যের অর্থকে সুষ্ঠুভাবে ঋণে রূপান্তর করা। কিন্তু ঋণ দেওয়া কেবল মুনাফা নয়। এটি একটি মূল্যায়নের প্রক্রিয়া, যেখানে গ্রাহকের আর্থিক সক্ষমতার পাশাপাশি চরিত্র, ব্যবসার প্রকৃতি, নগদ প্রবাহ এবং শিল্প খাতের প্রবণতাও বিবেচনা করতে হয়।
অভিজ্ঞ ব্যাংকাররা জানেন, একটি ঋণ ব্যর্থ হলে তার পেছনে শুধু অর্থনৈতিক দুর্বলতা থাকে না। থাকে গ্রাহককে সঠিকভাবে বোঝার ভুল, উদ্দেশ্যের অস্পষ্টতা বা প্রক্রিয়াগত ঘাটতি। তাই ক্রেডিট বা ঋণ ঝুঁকি মূল্যায়ন কেবল সংখ্যার হিসাব নয়। এটি ব্যবসার টেকসই সামর্থ্য বোঝার দক্ষতা। বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো এখনও অনেকাংশে কাগজভিত্তিক হিসাবনির্ভর ঝুঁকি মূল্যায়নের ওপর নির্ভরশীল। অথচ আমাদের দরকার ঝুঁকি-সচেতন সংস্কৃতি। যেখানে ঋণ অনুমোদন মানে হবে ব্যবসা বোঝা, ঝুঁকি চেনা এবং প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা। আজকের ব্যাংকিং কাগজে-কলমের সীমাবদ্ধতায় আটকে নেই। প্রযুক্তি এখন প্রতিটি লেনদেনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এর সঙ্গে এসেছে নতুন ঝুঁকি—অপারেশনাল বা পরিচালনা ঝুঁকি। এটি দেখা দেয়, যখন প্রক্রিয়া দুর্বল থাকে, মানুষ দ্বারা ভুল সংঘটিত হয় বা অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণে ফাঁক-ফোকর থাকে।
ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের যুগে অপারেশনাল ঝুঁকি অনেকাংশে জড়িত সাইবার নিরাপত্তা ও তথ্যের সঠিকতার সঙ্গে। একটি মাত্র সিস্টেম ব্যর্থতা বা তথ্য ফাঁস বহু বছরের আস্থা মুহূর্তে ধ্বংস করতে পারে। তাই আধুনিক ব্যাংকারকে শুধু আর্থিক বিশ্লেষক নয়, প্রযুক্তিবিদ হিসেবেও ভাবতে হয়। তাকে বুঝতে হবে, অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ বা কমপ্লায়েন্স কোনো প্রশাসনিক ঝামেলা নয়। এটি ব্যাংকের বিশ্বাসযোগ্যতার মূল স্তম্ভ। সুদের হার, মুদ্রা বিনিময় হার বা শেয়ার মূল্যের ওঠানামা থেকে আসে বাজার ঝুঁকি বা মার্কেট রিস্ক। উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলো, বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো আমদানিনির্ভর অর্থনীতি, বৈশ্বিক নীতি পরিবর্তন বা ভূরাজনৈতিক অস্থিরতার প্রভাবে সহজেই অস্থির হয়ে পড়ে।
একজন দক্ষ ঝুঁকি ব্যবস্থাপক কেবল মুদ্রানীতি বা ট্রেজারি সিদ্ধান্তে সীমাবদ্ধ থাকেন না। তিনি বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রবণতা, পণ্যবাজারের হালচাল এবং নীতি পরিবর্তনের ইঙ্গিত পড়তে পারেন। একজন ভালো ব্যাংকারের পরিচয় পাওয়া যায় তার তারল্য রিজার্ভ ধরে রাখার সক্ষমতা, সম্পদ-দায়-সমন্বয় বোঝার দক্ষতা এবং বাজার কোন দিকে যাচ্ছে তা আগেভাগে অনুভব করার দূরদর্শিতায়।
আজকের বিশ্বায়িত আর্থিক ব্যবস্থায় ‘কান্ট্রি রিস্ক’ বা ‘সার্বভৌম ঝুঁকি’র গুরুত্ব বেড়েছে অনেক। যখন কোনো ব্যাংক আন্তর্জাতিক বাণিজ্য অর্থায়ন করে বা বিদেশী সম্পদে বিনিয়োগ করে, তখন সেটি পরোক্ষভাবে সেই দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার ভারও কাঁধে তুলে নেয়। কোথাও সার্বভৌম ঋণখেলাপি ঘটে বা হঠাৎ নীতি পরিবর্তন হয়, তার প্রভাব সরাসরি দেশীয় ব্যাংকের ব্যালান্স শিটে পড়ে।
তাই প্রয়োজন বিচক্ষণ বৈচিত্র্য বা যাকে আমরা বলি ‘সব ডিম এক পাত্রে না রাখা’। পাশাপাশি প্রয়োজন বৈশ্বিক ঝুঁকির সূচক সম্পর্কে সচেতনতা ও ধারাবাহিক পর্যবেক্ষণ। একটি শক্তিশালী ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা বিভাগ কেবল রিপোর্ট তৈরিতে সীমাবদ্ধ থাকবে না। বরং এটি হবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের মূল কেন্দ্রবিন্দু। সবচেয়ে সূক্ষ্ম অথচ গভীর প্রভাব ফেলে এমন একটি ক্ষেত্র হলো সুনামগত বা খ্যাতির ঝুঁকি। কোনো নৈতিক বিচ্যুতি, অনৈতিক ঋণ সিদ্ধান্ত, বা অনভিপ্রেত যোগাযোগ—সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করে প্রতিষ্ঠানের বিশ্বাসযোগ্যতাকে। ব্যাংকের সুনাম প্রতিদিন গড়ে ওঠে গ্রাহক, নিয়ন্ত্রক ও সমাজের সঙ্গে সম্পর্কের ওপর।
সুনাম রক্ষা কেবল জনসংযোগ বিভাগের কাজ নয়। এটি প্রতিটি কর্মকর্তা ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপকের নৈতিক দায়িত্ব। একজন ঝুঁকি ব্যবস্থাপক হতে হবে প্রতিষ্ঠানের নৈতিক কম্পাস। তিনি নিশ্চিত করবেন, প্রতিটি সিদ্ধান্ত ন্যায্যতা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির মানদণ্ডে উত্তীর্ণ হচ্ছে। একজন ভালো ঝুঁকি ব্যবস্থাপক কেবল ‘না’ বলার জন্য পরিচিত নন। তার কাজ হলো ঝুঁকিকে সঠিকভাবে বোঝা ও পরিচালনা করা। তিনি একসঙ্গে অভিভাবক, কৌশলবিদ ও বিশ্লেষক।
বাংলাদেশের ব্যাংক খাত যখন বৈশ্বিক অর্থনীতির সঙ্গে গভীরভাবে সংযুক্ত হচ্ছে, তখন দক্ষ, নৈতিক ও দূরদর্শী ঝুঁকি ব্যবস্থাপকের প্রয়োজন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। যেসব ব্যাংক পেশাদারদের প্রশিক্ষণ, ক্ষমতায়ন ও নেতৃত্ব গড়ে তুলবে, তারা কেবল বৈশ্বিক আর্থিক চাপ সহ্য করেই টিকবে না। বরং সেই চাপের মধ্যেও নিজেদের বিকশিত করার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে।
মামুন রশীদ: ব্যাংকার ও অর্থনীতি বিশ্লেষক। সূত্র: বনিক বার্তা

